বিষয় – মণিপুর হিংসা

(সৌরভ কুন্ডুর প্রতিবেদন)

আজ ৫০ দিনের উপর হয়ে গেল, মণিপুরে যে ধ্বংসাত্মক হিংস্রতা, যে রক্তক্ষয়, মৃত্যু, বা দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে, সে ব্যাপারে ভারত সরকারের সম্পূর্ণ চুপ করে বসে থাকার কারনে তা’ এক অবিশ্বাসের সুদীর্ঘ বাতাবরন তৈরি করেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট জেনারেল এক প্রকার বাধ্য হয়ে মণিপুরকে “রাষ্ট্রহীন” বলে অভিহিত করেছেন এবং সেনাবাহিনীর একজন প্রাক্তন প্রধান ভারতকে লেবানন-নাইজেরিয়া-সিরিয়ার সাথে তুলনা করতে বাধ্য হয়েছেন । সরকারের তরফে কেউ কি আদৌ শুনছেন?সবাই জানেন, বুঝতে পারছেন, মণিপুরের একটি রাজনৈতিক সমাধান প্রয়োজন, কিন্তু মোদি সরকার কেবলমাত্র পুলিশ ও সেনা মোতায়েন করে যেভাবে আইন ও শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইছেন, সেভাবে যে আর সম্ভব নয়, সেটা তারা কিছুতেই বুঝতে চাইছেন না বা নির্বুদ্ধিতার কারণে পারছেন না !

বিগত ৩রা মে থেকে মণিপুর কি কি হয়েছেঃ

▪ ১৫ ০ জনের বেশি মৃত,

▪ ৫০,০০০ এর বেশি পরিবার বাস্তুচ্যুত,

▪ ১৫টি সম্প্রদায়ের ১২১টিরও বেশি গির্জা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে,

▪ ৫,000 টিরও বেশি অস্ত্র লুট করা হয়েছে ( যার মাত্র ১১০০টি ফেরত দেওয়া হয়েছে),

▪ এমনকি পররাষ্ট্র বিষয়ক রাজ্যমন্ত্রীর বাড়িও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, এর পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক সরকারি ভবন ধ্বংস করা হয়েছে।

সবথেকে অদ্ভুত লাগবে যদি আপনারা ক্ষমতাসীন বিজেপির মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য এবং মণিপুর কেন জ্বলছে সে সম্পর্কে আমাদের সেনা জেনারেলের উপলব্ধি শোনেন ! মণিপুর পরিচালনার যে বিভ্রান্তি তা এদের বক্তব্যে সবচেয়ে ভালভাবে বর্ণিত হয়েছে?

▪মণিপুরের বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী এই অসম্ভব হিংসাকে “সন্ত্রাসবাদীদের” কাজ বলে বর্ণনা করেছেন।

▪ আর আমাদের আর্মি জেনারেল অনিল চৌহান এক কাঠি উপরে উঠে বলেছেন, ‘বিদ্রোহ প্রতিরোধের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই কারণ এটি মূলত দুটি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ।’তবে, যে যাই বলুন, আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী মোদী মণিপুর সম্পর্কে আজও ততটাই “অমনোযোগী” রয়ে গেছেন এবং এখনও পর্যন্ত না তাঁর কোন বিবৃতি পাওয়া গেছে, না এই হিংসা থামানোর স্বপক্ষে কোন আবেদন। প্রধানমন্ত্রী মণিপুরে এখনও যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেন নি ( অথচ তিনি জাপান, পাপুয়া নিউগিনি এবং অস্ট্রেলিয়া সফরের সময় ঠিক পেয়েছেন এবং কাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন), বা মণিপুরের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার জন্য একটি সভা আহ্বান করে একবারও বিশদে জানতে চান নি, মণিপুরের ১০টি বিরোধী দল চিঠি লিখে আবেদন করা সত্বেও। ৩রা মে থেকে গত ৫০ দিনে একবারও হিংসা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেননি বা একটাও কথা কোথাও বলেননি!স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ মৃত্যু ও ধ্বংস লীলা শুরু হওয়ার ২৭ দিন পরে মণিপুরে যাওয়ার সময় করে উঠতে পেরেছেন। তার সমাধান বস্তুতপক্ষে শূন্য ফল দিয়েছে ( কারণ তাঁকে অযোগ্য বলেই দেশের মানুষ জানেন ) এবং তারপর থেকেই তিনি মণিপুরকে সম্পূর্ণরূপে এমনভাবে উপেক্ষা করেছেন যেন এটি তার আওতাভুক্তই নয়। বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং অবশ্যই পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং রাজ্যে সরকারি যে কোন প্রচেষ্টা সেখানে সম্পূর্ণ বিফল হয়েছে । বিজেপির জাতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা মণিপুর সম্পর্কে একটাও কথা বলেছেন এমন দাবি কেউ করুক দেখি ! তাঁর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে কিছুই যেন ঘটে নি। আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য আমাদের সেনাবাহিনী এবং পুলিশের কাঁধে সবকিছু ফেলে দেওয়া হয়েছে এবং মোদী ও তাঁর অপদার্থ সরকার পরিষ্কার হাত ধুয়ে ফেলেছে বলে মনে হচ্ছে।কিন্তু পাঠক, আপনারাই বলুন, এতে কি কাজ হবে?দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে এটি কি আদৌ প্রত্যাশিত? প্রধানমন্ত্রীর কি অবিলম্বে উদ্যোগ নেওয়া উচিত নয়? আপনাদের কি মনে হয় না, প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় সরকারের, উভয় জাতিগোষ্ঠীর সাথে নতুন করে বার্তালাপ শুরু করা উচিত ? এই হিংসার যারা শিকার, তাদের কি প্রধানমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে সরাসরি নিরাময় স্পর্শের প্রয়োজন নেই, যাতে তাদের সহায়তা এবং পুনর্বাসনের সহৃদয় আশ্বাস দেওয়া হয়? প্রধানমন্ত্রীর কি স্বীকার করা উচিত নয় যে মণিপুর রাজ্য বিজেপি সরকার সংবিধান অনুযায়ী সরকার চালাতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে? প্রধানমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় সরকারের অবশ্যই নিশ্চিত করা উচিত যে আমাদের সেনাবাহিনীর উপর দায় চাপানোর পরিবর্তে তারা যেন উত্তেজনাপূর্ণ এই হিংসা এবং দৈনন্দিন জনজীবন ব্যাঘাতের অবসান ঘটান এবং স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া পুনরুদ্ধার করা হয়।কিন্তু,মোদি সরকার কি আদৌ শুনছেন ? প্রধানমন্ত্রী কি সত্যিই চান যাতে এই হিংসা বন্ধ হয় ? ভারত সরকার কি উদ্বিগ্ন? এখন তো রাজনীতি কেউ করতে চাইছেন না, এখন জাতীয় স্বার্থে কাজ করার সময়!এবার আপনাদের সামনে মণিপুর বিষয়ে এমন কিছু তথ্য দেব বা এমন কিছু জরুরি বিষয় রয়েছে যা প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, মোদী সরকার এবং এমনকি মূলধারার মিডিয়াও ( এদের কথা যত কম বলা যায় তত ভাল ) খুব কম মনোযোগ দিয়েছেন বা যার উত্তর পাওয়া যায় নিঃ

১) আসাম রাইফেলস এবং মণিপুর পুলিশের মধ্যে এমন কি কোন বিভেদ আছে যা আজ পর্যন্ত সুরাহা করা হয় নি? আসাম রাইফেলস এবং মণিপুর পুলিশের মধ্যে কি কোন নিরাপত্তা সংক্রান্ত বোঝাপড়া হয়েছিল, যখন আসাম রাইফেলস এর তিনটি ‘ক্যাসপির’ গাড়ি সুগনু থানার প্রবেশদ্বার এবং রাস্তাগুলি অবরুদ্ধ করে রেখেছিল? রাস্তা অবরোধ সংক্রান্ত ভিডিওগুলি কি পাবলিক ডোমেনে উপলব্ধ নয় ? প্রকৃতপক্ষে কি ঘটেছিল এবং কেন ভারত সরকারের কাছ থেকে কোন প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে না ?

২) ‘সাসপেনশন অফ অপারেশনস’ (SOO) চুক্তির প্রাথমিক নিয়ম গুলি কি ২০০৮ সালে লঙ্ঘিত হয়েছে? নির্ধারিত কুকি ক্যাম্প গুলি থেকে কি সশস্ত্র ক্যাডার ও অস্ত্র নিখোঁজ হয়েছে?পাঠক, আপনারা কি মনে করেন ? এটি কি আমাদের দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ব্যর্থতা নয় এবং কেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এবং ভারত সরকার এতে ‘নিঃশব্দ’?

৩) অমিত শাহ এবং ভারত সরকার NH 2-এর উপর ‘অর্থনৈতিক অবরোধ’ তুলে ফেলছেন, যা মণিপুরে সমস্ত পণ্য সরবরাহের জন্য লাইফ লাইন? ইন্টারনেট স্থগিত থাকা অবস্থায়, অমিত শাহের একটি টুইট কি যথেষ্ট কারণ মানুষ তো অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে সবচেয়ে খারাপ অপরাধের শিকার হচ্ছে?

৪) বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং কি প্রকাশ্যে বলেছেন যে মণিপুর রাজ্য পুলিশ বাহিনী কেন্দ্রীয় বাহিনীর থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করবে? মুখ্যমন্ত্রী কি এর আগে সেনাপ্রধান অনিল চৌহানের বিপরীত অবস্থান নেননি? এটি কি মণিপুরের মতো উদ্বেগজনক পরিস্থিতি পরিচালনার বিষয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে একটি আপাতদ্বন্দ্বকে চিত্রিত করে না? প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক এই ইস্যুতে নীরব কেন?

৫) রাষ্ট্রীয় বাহিনী/কমান্ডোদের কোন সদস্যকে কি খামেনলোকে মিলিশিয়া হামলার অংশ হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছে? এর মধ্যে কি সামান্যতম সত্য আছে? সেই খোঁজ কি করা হয়েছে

৬) মণিপুর রাজ্যে জাতিগত বিভাজন কি গভীরভাবে বিভক্ত? রাজ্যের ক্যাবিনেট মন্ত্রীর (কুকি বংশোদ্ভূত) বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া এবং পরবর্তীকালে বিদেশবিষয়ক (মেইতেই বংশোদ্ভূত) একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া কি একটি প্যাটার্ন প্রতিফলিত করে ? নাকি এইগুলো সব এলোমেলো অথচ সহিংস কাজ ?

৭) কেন প্রধানমন্ত্রী মণিপুর যাচ্ছেন না? প্রধানমন্ত্রী কেন বিস্ফোরক পরিস্থিতি খতিয়ে দেখছেন না? জাতীয় কংগ্রেসের দাবি অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী কেন সমস্ত রাজনৈতিক দলকে নিয়ে সরব দলীয় বৈঠক করছেন না? প্রধানমন্ত্রী কেন পরিস্থিতি প্রশমিত করার জন্য তাঁর সরকার কী পদক্ষেপ নেবে সে সম্পর্কে সমগ্র দেশকে অবহিত করছেন না? প্রধানমন্ত্রী আপনি দয়া করে মণিপুরকে আর উপেক্ষা করবেন না! মণিপুর হল ভারতের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং মোদি সরকারের উচিত জেগে ওঠা এবং রাজ্যের স্বার্থে অবিলম্বে এই সমস্যার সমাধান করা!

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *