ইন্দিরা গান্ধী – তৃতীয় বিশ্বের এক অবিসংবাদী নেত্রী

অমিতাভ সিংহ

মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়সে পিতামহ মতিলাল নেহেরুর কোলে চেপে ছোট্ট মেয়েটি আদালতের কাঠগোড়ায় হাজির হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনিই ভারতের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী। ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী গান্ধী। তিনিই সেই ছোট্ট শিশু যাকে তার সাধের সুন্দর পুতুলগুলোসহ প্রিয় পোষাকটিও বাড়ীর বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন বিদেশি দ্রব্য বর্জনের ডাকে। বানরসেনার নেতৃত্বেও ছিলেন তিনি।তাঁকে লেখা তাঁর পিতার চিঠিগুলি আজও ইতিহাস ও সাহিত্যে এক পরম সম্পদ যা প্রায় সব শিক্ষিত ভারতবাসী ইতিমধ্যেই পড়ে ফেলেছেন। লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর পর তাঁকেই কংগ্রেসের বরিষ্ঠ নেতারা প্রধানমন্ত্রী করলেন।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই তাঁর সামনে এল নতুন চ্যালেঞ্জ। দেশ তখন চলছে এক সংকটময় অবস্থার মধ্যে। প্রতিবেশি দেশের সাথে যুদ্ধের ফলে অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ খারাপ।খরা,খাদ্যাভাব ও দ্রব্যমুল্য বৃদ্ধির জন্য শুরু হল হিংসাত্মক খাদ্য আন্দোলনের সাথে শ্রমিক বিক্ষোভ। দক্ষিন ভারতে ভাষা আন্দোলন।কিন্তু তিনি তো থেমে থাকার পাত্র নন।নিলেন একের পর এক বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত।
খাদ্য ঘাটতি এলাকায় দ্রুত খাদ্য সরবরাহ, দুর্ভিক্ষ পীড়িত এলাকায় ত্রানকার্য,শহরাঞ্চলে নাজ্যমুল্যের দোকান খোলার ব্যবস্থা। সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে খাদ্যসংকট মোকাবিলা করা হল।পরের বছর লোকসভার নির্বাচনের পর দ্বিতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু ১৭ টি রাজ্যের মধ্যে ৯ টি রাজ্যে পরাজয় হল কংগ্রেসের। মোকাবিলা করলেন অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে।অর্ডিন্যান্স জারি করে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ করে সাধারন মানুষের আস্থা অর্জন করলেন।তারপরই রাজন্য ভাতা বিলোপ বিল আনা।কিন্তু সুপ্রীম কোর্ট দুটি অর্ডিন্যান্সকেই বাতিল করল।
১৯৭১ সালে নির্বাচনে কংগ্রেসকে ৩৫০টি আসনে বিজয়ী করলেন দেশের মানুষ। এমআরটিপি আক্ট,রাস্ত্রীয় শিল্পকে প্রাধান্য দেওয়া,৩৮ টি পন্যের ওপর সরকারী নিয়ন্ত্রন,১৭ টি ওষুধের মূল্য হ্রাস,শিল্প পরিচালনায় কর্মচারী প্রতিনিধির অর্ন্তভুক্তি,শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, গ্রামাঞ্চলের মানুষের দারিদ্র দূরীকরণ ও কর্মসংস্থানের কর্মসূচির সাথে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ,২১৪ টি কয়লা খনি অধিগ্রহণ,১০৬ টি দেশী বিদেশী বীমা কোম্পানি অধিগ্রহণ, রাজন্য ভাতা বিলোপ, কিছু হাল্কা শিল্প অধিগ্রহন করা হল। তারই প্রতিফলন ঘটে ১৯৭২ এর বিধানসভা নির্বাচনে। পরাজিত হওয়া ৯ টি রাজ্যের প্রায় সবকটি রাজ্য আবার ফিরে আসে কংগ্রেসের হাতে।
এরপরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে সার্বিক সমর্থন। আমেরিকার ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে তিনি যেভাবে পাকিস্তানের কবল থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনেছিলেন তা তো ইতিহাস। অটলবিহারী বাজপেয়ী তাঁকে দেবী দূর্গার সাথে তুলনা করলেন।এভাবেই তিনি হলেন এশিয়ার মুক্তিসূর্য।ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে ভারত সোভিয়েত শান্তি ও মৈত্রী চুক্তি।তারপরই হল পাকিস্তানের সাথে সিমলা চুক্তি।
১৯৭৪-৭৫ সালে দেশে রেকর্ড পরিমানে ফসল উৎপাদন হল। কালোবাজারি বিনাশ,নিয়মানুবর্তিতা, শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সমগ্র অর্থনীতির উর্দ্ধগতি দেখা গেল। ২০ দফা কর্মসূচি অনুযায়ী দ্রুত কৃষি সংস্কার, নূন্যতম মজুরি, কৃষিঋণ মকুব,গৃহহীনদের জমি,আয়কর হ্রাস ইত্যাদির সুফল জনগন পেতে লাগলেন। আর্যভট্ট উৎক্ষেপন,পরমানবিক বিষ্ফোরণ ইত্যাদির মাধ্যমে ভারত বিশ্বের দরবারে এক শক্তিধর দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশের করল।

তিন বছর তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না।কিন্তু তিনি থেমে ছিলেন না।দেশের প্রতিটি রাজ্যে তিনি ছুটেছেন তাদের দুঃখের সহযোগী হতে। দেশের মানুষ তাদের ভূল বুঝতে পেরে ১৯৮০ সালে দুই তৃতীয়াংশ আসনে কংগ্রেসকে বিজয়ী করে তাঁকে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী করলেন।বার বার তার প্রাননাশের চেষ্টা হল।তার সময় সফলভাবে দেশে এশিয়ান গেমস সম্পন্ন হল।জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনের সভানেত্রী হলেন।
অকালী দল পান্জাবে হেরে যাবার পর সেখানে আগুন ধরানো হল।শুরু হল বিচ্ছিনতাবাদী খালিস্থান অান্দোলনের। অমৃতসর স্বর্ণমন্দির ধাত্রীভূমি হয়ে উঠলো সন্ত্রাসবাদের।১৯৮৪ সালের ৫ জুন নামাতে হল সেনাকে পবিত্র স্থানটি জঙ্গীমুক্ত করার জন্য। তিনি জানতেন এর বড় মূল্য দিতে হবে। গোয়েন্দা দপ্তর, র ও বিদেশী রাষ্ট্রনায়কেরা বলেছিলেন তার নিরাপত্তারক্ষীর মধ্যে থেকে শিখ নিরাপত্তারক্ষীদের সম্পূর্ণ বাদ দিতে। কিন্তু একটা ধর্মের মানুষের প্রতি এই আচরণ তার পছন্দ ছিল না। গণতন্ত্রের ও সর্বধর্মের প্রতি সমান আচরনের শিক্ষা তাতে সায় দেয় নি। তাই শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে তার হিসাব তিনি চুকিয়েছেন।আজ তাঁর ১০৬তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁকে প্রনাম।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *