নেহরুর পরে কি ইন্দিরার স্মৃতি সৌধে পরিবর্তন !

শুভাশিস মজুমদার

কংগ্রেস সাংসদ জয়রাম রমেশের সাথে সোশ্যাল মিডিয়ায় বাক্য বিনিময়ের (পড়ুন বিতর্কের) সময় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিংয়ের একটি মন্তব্য নেহেরু-গান্ধী পরিবারের সাথে যুক্ত আরেকটি প্রতিষ্ঠান ইন্দিরা গান্ধী মেমোরিয়ালকে কেন্দ্র (মোদী সরকার) বন্ধ করার বিষয়ে আশঙ্কা তৈরি করেছে।

এই বিষয়ে, দুই ঐতিহাসিক, বহুল প্রচারিত দৈনিক সংবাদপত্র, দ্য টেলিগ্রাফকে বলেছেন যে তাঁরা এই ধরনের যেকোনো পদক্ষেপের বিরোধিতা করেন, তাঁদের মধ্যে একজন এই ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করাকে উপনিবেশবাদের পুনঃস্থাপন হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
নতুন সংসদ ভবনের স্থাপত্য নিয়ে জয়রাম রমেশের সমালোচনার প্রতিক্রিয়ায়, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিং গত মাসে এক্স প্ল্যাটফর্মে লিখেছিলেন: “আমি দাবি করছি যে সমগ্র ভারতে #ডাইনাস্টিক ডেন্স (বংশবাদের আস্তানা) এর পুনর্মূল্যায়ন এবং তাদের যুক্তিগ্রাহ্য করা দরকার।”

শুরু করার জন্য তিনি বেছে নিয়েছেন ১, সফদরজং রোড কমপ্লেক্স, যা অবিলম্বে ভারত সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হোক – এই তাঁর দাবি।

ঠিকানাটি হল ইন্দিরা গান্ধী মেমোরিয়াল (আই জি এম)। এই বাড়িটিতে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী থাকতেন এবং ১৯৮৪ সালের ৩১শে অক্টোবর এখানেই তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। সম্ভবত দিল্লির সবচেয়ে বেশি দর্শনীয় পর্যটন আকর্ষণ এটি। ইন্দিরা এবং তাঁর উত্তরসূরি পুত্র রাজিব গান্ধীর মৃত্যুর সময় পরিধান করা পোশাক প্রদর্শিত আছে এখানে। রাজীবকে ১৯৯১ সালে তামিলনাড়ুর শ্রীপেরুমবুদুরে হত্যা করা হয়েছিল, যেখানে এখন একটি স্মৃতিসৌধ রয়েছে।

“এই বাড়িটিতে তিনি (ইন্দিরা গান্ধী) কেবলমাত্র থেকেছিলেন তাই নয়, এটি সেই বাড়ি যেখানে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল।… যে জায়গাটিতে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল সেটি চিহ্নিত করা রয়েছে,” মৃদুলা মুখার্জি, ইতিহাসবিদ এবং নেহেরু মেমোরিয়াল মিউজিয়াম অ্যান্ড লাইব্রেরির (এন এম এম এল) প্রাক্তন পরিচালক, এই কথা বলেন দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকা কে। উল্লেখ্য, মোদী সরকার এন এম এম এল -এর নাম পরিবর্তন করে প্রধানমন্ত্রী মিউজিয়াম ও গ্রন্থাগার রেখেছে এবং অন্যান্য প্রধানমন্ত্রীদের সম্পর্কে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছে। যা পণ্ডিত নেহেরুর প্রতি অবমাননাকর এবং তাঁর কৃতিত্বকে খাটো করে দেখানোর মোদী সরকারের প্রচেষ্টা বলে সমালোচনা হয়েছে। অন্যান্য প্রধানমন্ত্রীদের সম্পর্কে মিউজিয়াম অন্যত্র অনায়াসেই করা যেত।
“ইন্দিরা গান্ধী মেমোরিয়াল বাড়িটি আত্মত্যাগের প্রতীকস্বরূপ, যা গুরুত্বপূর্ণ। আমি আশ্চর্য হয়েছি, যে বর্তমান সরকার খালিস্তান আন্দোলনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা ফলাও করে বলে, তারাই এই প্রাঙ্গণ ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলছে। এটি এমন একজন ব্যক্তির স্মৃতিসৌধ যিনি এই (খালিস্তান) আন্দোলনের মোকাবিলায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।… আজ তারা (বিজেপি) পাকিস্তান ভাঙার কথা বলে। ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধী একমাত্র প্রধানমন্ত্রী ছিলেন যিনি এই কাজ করেছিলেন,” মৃদুলা মুখার্জি বলেন।

তিনি যোগ করেছেন: “এটি একটি ছোট এবং সুন্দর স্মৃতিসৌধ যা খুব জনপ্রিয়, বিশেষ করে দক্ষিণের দর্শকদের কাছে। ইন্দিরা আম্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সারিবদ্ধভাবে তারা অপেক্ষা করেন। সম্ভবত সে কারণেই তারা (বিজেপি সরকার) এটি বন্ধ করতে চায়।”

২৭ মে, ১৯৮৫-এ আইজিএম-এর উদ্বোধন হয়েছিল। দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় পরের দিনের সংস্করণে মানিনি চ্যাটার্জির প্রতিবেদনে জায়গাটির “মার্জিত ও সুরুচিপূর্ণতার” বর্ণনা করা হয়েছে।

“তাঁর টেবিলে একজোড়া চশমা পড়েছিল, যেটি সেই সকালে রওনা হওয়ার আগে অবশ্যই তিনি একপাশে রেখেছিলেন। একটি ডায়েরি এবং একগুচ্ছ প্রয়োজনীয় ছোটখাটো জিনিস, নান্দনিকভাবে সাজানো ছিল টেবিলে। রাবার ব্যান্ডের সাথে একটি ক্ষুদ্রাকৃতির হরিণের শিং এবং নরওয়েজিয়ান ভাইকিং বোটটি পিন, ক্লিপ, ব্লটার এবং ইরেজার দিয়ে ভর্তি করে রাখা” – প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

“গাইডরা জোর দিয়ে বলেন যে এইগুলি ৩১ অক্টোবর যেমন ছিল তেমনই রাখা রয়েছে, এবং কোনও জিনিস স্পর্শ করা হয়নি। হোয়াইটওয়াশের নতুন প্রলেপ এবং তাজা রঙের গন্ধ এই স্নিগ্ধ পরিবেশের বাতাসে মিশে আছে।”

“অত্যন্ত ভালোবাসার সাথে রক্ষণাবেক্ষণ করা বাগানে ইন্দিরা গান্ধীর অস্তিত্ব অনুভূত হয়। লনের মাঝখানে, যেখানে তিনি তাঁর নাতি-নাতনিদের সাথে যতটা সম্ভব খেলতেন, সেখানে একটি কোরিজিয়া গাছ আছে, যা তিনি ১৯৬৬ সালে রোপণ করেছিলেন। তার মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগে, গাছটিতে হঠাৎ রোগ এবং ক্ষয়ের লক্ষণ দেখা যায় এবং তিনি ব্যক্তিগতভাবে এর তত্ত্বাবধান করেন। পুনরুদ্ধার হওয়া গাছটি, একটি ফাটলযুক্ত কাণ্ড সহ, এখনও একটি চীনা লণ্ঠন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যা (লন্ঠনটি) বিকেলের হাওয়ায় অলসভাবে উড়ছে, সুখী সময়ের স্মৃতি।”

গত বছর তিন মূর্তি কম্পাউন্ডে পিএম মিউজিয়াম বা প্রধানমন্ত্রী সংগ্রহালয় উদ্বোধন করা হয়েছিল। তিন মূর্তি ভবন, যেখানে ইন্দিরার বাবা জওহরলাল নেহেরু থাকতেন, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটি স্বতন্ত্র “হাউস মিউজিয়াম”-এ রূপান্তরিত হয়েছিল। এর পিছনে নির্মিত নতুন পিএম মিউজিয়ামের সাথে এটিকে একত্রিকরণ করা হয়েছে।

গত মাসে প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তন করে এন এম এম এল থেকে প্রাইম মিনিস্টার মিউজিয়াম এবং লাইব্রেরি করা হয়েছে। মেন গেটের পিছনে নিরাপত্তা পোস্ট স্থাপন করা হয়েছে। এটির সম্মুখভাগের চেহারা পরিবর্তন হয়েছে।

উত্তরপ্রদেশের গ্রেটার নয়ডার শিব নাদর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা ইতিহাসবিদ এবং মিউজিয়াম বিশেষজ্ঞ সুদেষ্ণা গুহ সংবাদপত্রকে বলেছেন, “বিশ্বব্যাপী মিউজিয়ামগুলি আজ সক্রিয় গবেষণার স্থান এবং এই প্রাতিষ্ঠানিক স্থানগুলিতে প্রবেশাধিকার বৃদ্ধির দাবি রাখে। প্রধানমন্ত্রী সংগ্রহালয়ে গবেষণার স্পষ্ট অভাব রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। বস্তুর লেবেলগুলি থেকে সত্যই কোনো তথ্য জানা যায় না, বেশিরভাগের এমনকি তারিখেরও অভাব রয়েছে। অধিগ্রহণ করা মিউজিয়ামটি ডিজিটাল প্রযুক্তিতে পূর্ণ বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু সেগুলোতেও বিষয়বস্তুর অভাব রয়েছে।”

তিনি যোগ করেছেন: “সংস্কারের নামে প্রতিষ্ঠানগুলিকে নির্মমভাবে ভেঙে ফেলা হচ্ছে। দিল্লিতে স্মৃতিসৌধের স্থান করায়ত্ত করে পরিবর্তন করা, আসলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের জন্য পুনর্নির্মাণ।… ভূদৃশ্য থেকে স্মৃতিস্তম্ভ মুছে ফেলা (একপ্রকার) সাম্রাজ্যবাদকে নিশ্চিত করে।

নেহেরু এবং ইন্দিরা ছাড়াও, রাজধানীতে আরো এক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর একটি হাউস মিউজিয়াম আছে, তিনি হলেন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। ইন্দিরা এবং শাস্ত্রী মিউজিয়ামগুলি ব্যক্তিগত ট্রাস্ট দ্বারা পরিচালিত হয়। এই বছর, কেন্দ্র আইজিএম ট্রাস্ট, এবং নেহেরু এবং রাজীবের সাথে সম্পর্কিত অন্য দুটি ট্রাস্টকে অনুদান কর থেকে ছাড় পাওয়ার তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে।

সুদেষ্ণা গুহ যোগ করেছেন: “লাল বাহাদুর শাস্ত্রী স্মৃতিসৌধটি তাঁর বাড়িতে তৈরি করা হয়েছিল এবং যার প্যাটার্ন তিন মূর্তি ভবনের নেহরু স্মৃতিসৌধের অনুসরণে নির্মিত বলে মনে হয়। দেশের প্রতি শাস্ত্রীর দৃষ্টিভঙ্গি এই হাউস মিউজিয়ামের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত।”

“নেহরু স্মৃতি বিজড়িত তিন মূর্তি , যাকে প্রধানমন্ত্রী সংগ্রহালয় দিয়ে সম্পূর্ণরূপে কম গুরুত্বপূর্ণ করার চেষ্টা করেছে, একটি লাইব্রেরি দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটি মিউজিয়াম-নির্মাণ কার্যকলাপের একটি পুরানো পদ্ধতি অনুসরণ করে, যেখানে সংগ্রহের সাথে সম্পর্কিত একটি গ্রন্থাগার এবং সংরক্ষণাগার সহ একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ মিউজিয়াম বা সংগ্রহস্থল গঠিত হয়েছিল।”

তিনি আরো বলেন: “ইন্দিরা গান্ধী তার বাসভবনে মারা গিয়েছিলেন, এবং এটি একটি স্মারক হিসাবে কাজ করে… শাস্ত্রী এবং (ইন্দিরা) গান্ধীর এই তথাকথিত ‘হাউস মিউজিয়াম’গুলি (আমাদের) একটি উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের কিছু বৈচিত্র্যময় ইতিহাস এবং রাজনীতি সম্পর্কে অবহিত করে। এগুলো ভেঙে ফেলার কোনো কারণ নেই। প্রকৃতপক্ষে, এটি করা বিপুল পরিমাণ অর্থের নিছক অপচয়।”

প্রধানমন্ত্রীদের প্রাক্তন বাসভবনগুলিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করার ধারণার বিরোধিতা করলেও, স্থপতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণবিদ এ.জি.কে. মেনন এই এলাকায় কেন্দ্রের কিছু পদক্ষেপের সমালোচনা করেছিলেন।

ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ট্রাস্ট ফর আর্ট অ্যান্ড কালচারাল হেরিটেজের সহ-প্রতিষ্ঠাতা, স্থপতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণবিদ এ. জি. কে. মেনন দ্য টেলিগ্রাফ সংবাদপত্রকে বলেছেন: “তিন মূর্তিতে যা হয়েছে তা দুঃখজনক। সরকার ইতিহাসে তার স্ট্যাম্প রেখে যেতে চাইছে। অবশ্যই, একটি পিএম মিউজিয়াম থাকা উচিত, তবে এটি একটি ঐতিহ্যবাহী ভবনের পাশে তৈরি করা উচিত ছিল না। সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্পটিও একই পদ্ধতিতে করা হচ্ছে।”

২০১৯ সালে ঘোষিত সেন্ট্রাল ভিস্তা রিডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের অংশ হিসাবে, কেন্দ্রীয় সরকারী অফিসগুলি কর্তব্য পথের পাশে নতুন ভবনগুলিতে চলে যাবে। জাতীয় মিউজিয়াম জনপথে অবস্থিত তার বর্তমান বাড়ি থেকে নর্থ ব্লক এবং সাউথ ব্লকে চলে যাবে এবং এর নাম হবে – যুগে যুগেন ভারত।

২০২৫ সালে নতুন মিউজিয়াম খোলার আগেই ন্যাশনাল মিউজিয়াম বন্ধ করে এর বিশাল সংগ্রহ গোডাউনে স্থানান্তরের বিরোধিতা করেছে বহু বিরোধী সাংসদ, শিক্ষাবিদ এবং ছাত্ররা।

               আর এস এস এবং বিজেপিপন্থী নেতাদের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধী এবং তাঁর পরিবারের অন্য নেতাদের উপর কুরুচিকর মন্তব্য করা এবং তাঁদের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত মিথ্যা অপপ্রচার করার মূল উদ্দেশ্য হল এঁদের বিচারধারা ও আদর্শ মানুষের মন থেকে মুছে ফেলা। নেহরু ও গান্ধী পরিবারের নেতারা দেশকে অখণ্ড রাখার অতন্দ্র প্রহরী এবং গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার একনিষ্ঠ পূজারী।
Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *