—মানস ঘোষ
আজ এমন এক দেশনেতার প্রয়াণদিবস.. যাঁর ছায়া এতটাই দীর্ঘ যে আজ পর্যন্ত রাজনৈতিক স্বার্থে, অনেক প্রবল শক্তিকেও, তাঁর ভাবমূর্তি বারবার কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করতে হয়…
ক’দিন থেকেই নানা সোশ্যাল সাইটে বিশেষত হোয়াটস্যাপে আজাদ হিন্দ ফৌজ সংক্রান্ত ভারী অদ্ভুত কিছু ফরোয়ার্ডেড পোস্ট দেখছি যেখানে জহরলাল নেহেরুকে ভিলেন বানানো হয়েছে। এই প্রোপাগান্ডার উদ্দেশ্য এবং কারা করছে তা খুব স্পষ্ট । প্রকৃত ইতিহাস না জানা ও তলিয়ে না ভাবার কারনে কেউ কেউ এই গাঁজাখুরি গল্পগুলো বেমালুম বিশ্বাস করে ফেলছে।
তাই প্রতিবাদ করা দরকার মনে হল।
আসলে ফেবু-হোয়াটস্যাপের কল্যাণে একটা সময়ের পর থেকে আমাদের মনে গপ্পো, গুজব আর ইতিহাস ঘোঁট পাকিয়ে খিচুড়ি হয়ে গেছে।
আমাদের মনে নেতাজী প্রেম যতটা, তার চাইতে অনেক বেশী নেহেরু-গান্ধী বিদ্বেষ। অথচ, এই নেতাজীই গান্ধীজিকে জাতির জনক আখ্যা দিয়েছিলেন আর ত্রিপুরি কংগ্রেসে যখন মহাত্মা গান্ধীর নির্দেশে ওয়ার্কিং কমিটির সব সদস্য পদত্যাগ করেন, একমাত্র জওহরলাল পদত্যাগ করেন নি, পাশে ছিলেন তিনি তাঁর অনুজপ্রতীম সহযোদ্ধা ও দ্বিতীয়বারের জন্য নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির (তখন কংগ্রেস সভাপতিকে তাই বলা হত) পাশে। এও তো ইতিহাস। নেতাজী তাঁর ফরোয়ার্ড ব্লকে যোগদানের প্রাথমিক শর্ত হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন যে ফরোয়ার্ড ব্লকের সদস্যদের কংগ্রেসের প্রাথমিক সদস্যপদ থাকতে হবে।
আজাদ হিন্দ বাহিনীর যুদ্ধবন্দীদের হয়ে কেস লড়ার জন্য আইনজীবীদের প্যানেলের অন্যতম প্রধান ছিলেন নেহেরু। তাঁর নেতৃত্বেই কংগ্রেস এই মামলার খরচা ও সৈনিকদের মাসোহারা দেওয়ার জন্য চাঁদা তুলছিল। সেইসময় INA এর যে সমস্ত সৈনিককে যুদ্ধাপরাধী ঘোষণা করা হয়েছিল, সবাইকেই মুক্ত করা সম্ভব হয়েছিল। নেতাজী আত্মপ্রকাশ করলেও তার ব্যত্যয় হত ভাবার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারন নেই। ১৯৪৬ এর সেপ্টেম্বরে নেহেরু ব্রিটিশ নিষেধ অগ্রাহ্য করে সিঙ্গাপুরে INAএর শহিদ বেদীতে মালা দিয়ে আসেন। (ভাবতে আশ্চর্য লাগে, যে লোকটার জীবনের মোট ৩৬৫০ দিন ব্রিটিশদের জেলে কেটে গেল, – এমনকি যার পত্নীকেও বারবার হাজতবাস করতে হয়েছে, তাকে আমরা মূল্যায়ন করি লেডি মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে তার সম্পর্ক দিয়ে!
এ যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অপার সৃষ্টির থেকে বড় হয়ে দাঁড়ালো, কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের মুখোরোচক গল্প !!)
যে ২১শে অক্টোবরের কথা বলা হচ্ছে সেদিন সিঙ্গাপুরে নেতাজী, “আজাদ হিন্দ” সরকারের প্রতিষ্ঠা করেন। আজাদ হিন্দ ব্যাংক, আজাদ হিন্দ নোট, ৭ টি দেশের স্বীকৃতি সবকিছুর পর দরকার ছিল কিছুটা ভূখণ্ড। তাদের দখলে থাকা আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপ আজাদ হিন্দ সরকারের হাতে তুলে দেয় জাপান। নেতাজী ১৯৪৩ এর ৩০শে ডিসেম্বর আন্দামানে তেরঙা পতাকা উত্তোলন করেন। দ্বীপদুটির নাম দেন যথাক্রমে স্বরাজ ও স্বদেশ।
ভারতের মূল ভূখন্ডে নেতাজী প্রথম তেরঙা স্থাপন করেন ১৪ই এপ্রিল ১৯৪৪, ইম্ফল থেকে ৪৫ কিমি দূরে মৈরাঙে। জাপানের পতনের সঙ্গে সঙ্গে নেতাজীর স্বপ্নভঙ্গ হলেও, আজাদ হিন্দ বাহিনীর এই অসম লড়াই, অসীম সাহস, – নতুন স্বপ্ন, আবেগ আর উন্মাদনার বীজ বুনে দিয়ে গিয়েছিল আপামর ভারতবাসীর মনে।
ঠিক সে সময়….
কি ভাবছিলেন ভারতের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ?
আন্তর্জাতিক স্তরে কিছু নীতিগত বাধ্যবাধকতার কারনে, সিপি আই, তোজো, হিটলার,ইত্যাদির সঙ্গে নেতাজীর হাতমেলানোকে ভালো চোখে দেখে নি, কিন্তু সেভাবে সক্রিয় বিরোধিতাও করে নি, যেটা করেছিল একটি বিশেষ সংগঠন।
আরএসএস। সাভারকার সরাসরি বলেন যে যুদ্ধ যখন দোরগোড়ায় এসে হাজির হয়েছে তখন হিন্দুদের তাকে সুযোগ হিসেবে নিতে হবে, ব্রিটিশ বাহিনীতে সব উইংয়েই ব্যাপকভাবে নাম লেখাতে হবে। শুধু ভাষণ নয়, কাজেও ঝাঁপিয়ে পড়েন সাভারকার। ( এ প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্রের নিজের লেখা ভারতের মুক্তিসংগ্রাম বইটার ১৯৯ পাতা পরে দেখতে অনুরোধ করছি) পরবর্তী কয়েক বছর ধরে রীতিমত রিক্রুটমেন্ট ক্যাম্প সংগঠিত করে ব্রিটিশ বাহিনীতে ‘হিন্দু’-দের নিয়োগ করতে থাকেন। এই রিক্রুটমেন্টের জন্য এমনকি একটি কেন্দ্রীয় বোর্ডও গঠন করে ফেলে হিন্দু মহাসভা ও আরএসএস, যে বোর্ড ব্রিটিশ সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগে কাজ করবে। সাভারকারের এই উদ্যোগ আজাদ হিন্দ বাহিনীকে বিধ্বস্ত করতে ব্রিটিশদের অত্যন্ত সহায়ক হয় এবং সাভারকারের রিক্রুট করা ‘হিন্দু’ সেবকরা উত্তর পূর্বাঞ্চলে আজাদ হিন্দ বাহিনীর বহু সেনাকে হত্যা করে।নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ বাহিনী যে কেবল ভারতের হিন্দু-মুসলমান-শিখ সহ সমস্ত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তাবাদের মূর্ত প্রতীক হয়ে দেশের মানুষের সামনে হাজির হচ্ছিল তাই নয়, সেই বাহিনীতে লক্ষ্মী শেহগালের নেতৃত্বে চালিত সম্পূর্ণত মহিলা যোদ্ধা ও মহিলা অফিসারদের ‘ঝাঁসির রাণী ব্যাটেলিয়ন’ ছিল নারী-পুরুষ সম-মর্যাদায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার অঙ্গীকার। বলা বাহুল্য জাত-ধর্ম-লিঙ্গ নির্বিশেষে সম মর্যাদায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এই জাতীয় মুখচ্ছবিটি আরএসএসের সবর্ণ-হিন্দুত্ববাদী-পৌরুষের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর। আরএসএস নিযুক্ত সেনাদের তাই আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া সহজ ছিল। উত্তর পূর্বাঞ্চলে পরাজিত আজাদ হিন্দ বাহিনীর যোদ্ধাদের অনেককে তারা হত্যা করেছিল।
অক্ষশক্তির সঙ্গে হাত মেলানোর প্রশ্নে গান্ধীজির সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের মতান্তর হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধারা ও জাপানের আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী নীতি দেখে গান্ধী – নেহেরু প্রমুখ আশঙ্কা করেছিলেন, অক্ষশক্তির জয় হলে ভারতকে কি জাপানের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করা যাবে, নাকি আবার নতুন করে পরাধীন হতে হবে? কিন্তু সেই মতান্তর কখনো মনান্তরে পৌঁছায় নি। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস অটুট ছিল। নাহলে আজাদ হিন্দ বাহিনীর দুটি বিগ্রেডের নাম থাকত না, গান্ধী বিগ্রেড আর নেহেরু বিগ্রেড। তাছাড়া সিঙ্গাপুরে রীতিমত কুচকাওয়াজ করে INA এর গান্ধী জন্মদিন পালন করার ছবি সকলেই দেখেছে।
এ প্রসঙ্গে ‘৪২এর ‘ভারত ছাড়ো ‘ আন্দোলন স্মর্তব্য যদিও কংগ্রেসের একাংশের মনোভাব ছিল,বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের বিব্রত করব না, তবু নেহেরু প্রায় একতরফা ভাবে দেশব্যাপী গণ-আন্দোলনের ডাক দেন। নেতাজী বিদেশ থেকে এই আন্দোলন সমর্থন করেন।
” পরাধীন ভারতে প্রথম ভারতীয় সরকার”এর স্বীকৃতি নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে, দেখে ভালো লাগলো। নীচের ঘটনাটিও
এ ক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে।
মাতঙ্গিনী হাজরার বলিদান ভুলে গিয়ে না থাকলে এটাও মনে পড়বে মেদিনীপুরের মাটিতে সেই প্রথম সরকারী ভবনের মাথা থেকে ইউনিয়ন জ্যাক নামিয়ে ওড়ানো হয়েছিল ভারতের জাতীয় পতাকা।
১৭ই ডিসেম্বর,১৯৪২ গঠিত হয়েছিল তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার। এর মেয়াদ ছিল ৮ই অগাস্ট ১৯৪৪ পর্যন্ত।
(কৌতূহলী পাঠকদের জন্য আরেকটা তথ্য, এর আগে ১৯১৫ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্রিটিশ বিরোধী দেশগুলির সাহায্য নেওয়ার জন্য, কাবুলে প্রথম provisional Indian Govt প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ সিং। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশদের প্রবল চাপে সেই সরকার ভেঙে দিতে হয়। যদিও ধারে ও ভারে আজাদ হিন্দ সরকারের সঙ্গে ১৯১৫এর সেই সরকারের কোনো তুলনা হয়না।)
এই লেখায়, কংগ্রেস, বাম বা বিজেপি কোনো রাজনৈতিক দলের নিন্দা করিনি। (অতএব লেখটাকে অরাজনৈতিক বলা যেতেই পারে।) ইতিহাস বিকৃতি করার অপচেষ্টাকে রুখতে চেয়েছি মাত্র। আর হ্যাঁ, নেতাজীর আত্মত্যাগ, বীরত্ব, দেশপ্রেমের কথা, আমি কিন্তু জানতে পেরেছি আমাদের দেশের স্কুল কলেজের তথাকথিত “কংগ্রেসকৃত সিলেবাসের” বই পড়েই, হাভার্ড না ম্যাসাচুসেটস থেকে নয়।
আর হ্যাঁ, নেতাজী সুভাষকে আরেকটু জানতে গেলে, নেহেরু ও ইন্দিরা আমলে ভারত সরকারের আর্থিক আনুকূল্যে প্রকাশিত, দুটি বই, – নেতাজীর বক্তৃতাসমূহ ও নেতাজী রচনাসংগ্রহের সব কটা খণ্ড পড়ে দেখতে অনুরোধ করব।
এই লেখা প্রতিটা শব্দের সত্যতা সম্পর্ক আমি আত্মবিশ্বাসী।
.. তবে যেহেতু এই লেখা প্রয়াণ দিবসের শ্রদ্ধার্ঘ্য, তাই এই post এ আমি কোনো তর্কবিতর্কে যেতে চাইনা, এবং কোনো ইতিহাস অজ্ঞের বস্তাপচা ধারণা সম্বলিত commentsও এখানে দেখতে চাইনা |নিচের প্রথম ছবিটা মন দিয়ে দেখবেন, পারলে লিঙ্কটা খুলে দেখে নেবেন.. তাহলেই বুঝতে পারবেন ওনার ব্যাপারে কুৎসা রটানোর জন্য কতরকম হীন পদ্ধতি নেওয়া হয়েছিল !