বিনায়ক দামোদর সাভারকরঃ এক ক্ষমাপ্রার্থী ‘বিপ্লবী

–সিদ্ধার্থ গুপ্ত :

১৮৯৩ সালে গো-হত্যাকে কেন্দ্র করে এক ভ্রাতৃঘাতী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রক্তাক্ত হয় তৎকালীন সংযুক্ত প্রদেশের আজমগড়। আজমগড়ের এই দাঙ্গার অভিঘাত কয়েক মাসের মধ্যেই গ্রাস করে তৎকালীন বোম্বাই প্রদেশকে। সেই অনুন্নত এবং প্রায় অনুপস্থিত যোগাযোগ ব্যবস্থার যুগেও দাঙ্গার বিভিন্ন গল্প লোকমুখে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি সেদিন।বোম্বাই প্রদেশের নাসিকের এক অখ্যাত গ্রামের দেশ বছরের একটি ছেলেকে দাঙ্গা সম্পর্কিত গুজব সেদিন এতটাই প্রভাবিত করে যে সে তার স্কুলের সহপাঠীদের নিয়ে গিয়ে স্থানীয় মসজিদে পাথর ছুঁড়ে বিক্ষোভ দেখায় আর বিনা বাধায় ফিরে এসে নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করে। এই দশবছর বয়সী ছেলেটি আর কেউ নয়, আধুনিক ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক শক্তির আদর্শ পুরুষ বিনায়ক দামোদর সাভারকর।

আধুনিক ভারতের ইতিহাসে দামোদর সাভারকর একটি বর্নময় এবং বিতর্কিত চরিত্র। সাভারকরকে বাদ দিয়ে আধুনিক ভারতে ইতিবৃত্ত সম্পুর্ন হয় না। আজ নতুন করে সাভারকরকে নিয়ে যে রাজনৈতিক তরজা শুরু হয়েছে তার বাইরে গিয়ে এই স্বল্প পরিসরে সাভারকরের জীবন ও রাজনৈতিক দর্শনের উপর আলোকপাতই এই ক্ষুদ্র প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য।

প্রথম জীবনে সাভারকরকে সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত করে লোকমান্য বাল গঙ্গাধর তিলকের হিন্দু পুনরুত্থানের আন্দোলন যা তিলক শুরু করেছিলেন বিদেশী শাসকের সামনে নতজানু স্বদেশবাসীকে আত্মমর্যাদা এবং আত্মগরিমাবোধে উদ্বুদ্ধ করতে। বোম্বাই প্রদেশে নেটিভদের রাজনৈতিক সভা সমিতির ওপর যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল বৃটিশ প্রশাসন, তাকে পাশ কাটিয়ে স্বদেশী রাজনৈতিক জমায়েতের উদ্দেশ্য নিয়ে তিলক শুরু করেন সার্বজনীন গনপতি উৎসব এবং শিবাজি উৎসব। যার আবডালে চলত রাজনৈতিক সভা এবং সেখানে ছকে ফেলা হতো বিপ্লবী কার্যকলাপের নীল নক্সা। কিশোর সাভারকর তিলকের এই কর্মকান্ডে সহজেই আকৃষ্ট হন। এরই মধ্যে সাভারকর “অভিনব ভারত” নামে এক বিপ্লবীগোষ্ঠী তৈরি করেন। এরপর ১৯০২ সালে সাভারকর পুনের প্রখ্যাত ফার্গুসন কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু তার বৈপ্লবিক কার্যকলাপ এবং বক্তৃতার কারণে অচিরেই তিনি কলেজ থেকে বহিস্কৃত হন।সাভারকারই বোধহয় এ দেশে স্বদেশী কার্যকলাপের জন্য কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বহিস্কৃত হওয়া প্রথম ব্যক্তি।

কলেজ থেকে সাভারকারের বহিষ্কার তিলককে অত্যন্ত ব্যথিত ও ক্রুদ্ধ করে। সেই সময় লন্ডনে শ্যামজি কৃষ্ণবর্মা ইন্ডিয়া হাউস স্থাপন করেছে। অক্সফোর্ডের প্রখ্যাত ব্যালিওল কলেজের প্রাক্তনী শ্যামজি কৃষ্ণবর্মা ছিলেন একজন সুপন্ডিত,স্বদেশপ্রেমী অর্থবান ব্যক্তি যিনি ভারতীয় ছাত্রদের ইংল্যান্ডেে পড়াশোনা করার জন্য স্কলারশিপএর ব্যবস্থা করেন। এছাড়াও শ্যামজি কৃষ্ণবর্মা হোমরুল আন্দোলনের সাথেও জড়িত ছিলেন। ‘ইন্ডিয়ান সোসিওলজিস্ট’ নামে একটি জাতীয়তাবাদী পত্রিকাও তিনি প্রকাশ করতেন। তিলকের চিঠি এবং সাভারকরের আবেদনপত্র পৌছায় সেই শ্যামজি কৃষ্ণবর্মার কাছে। সাভারকরের আবেদনপত্রের প্রথম পংক্তিটিই ছিল, “Independence and Liberty I look upon as the pulse and breath of the nation.” দামোদর সাভারকর সহজেই শিরাজীর নামাঙ্কিত স্কলারশিপ পেয়ে যান এবং ১৯০৬ সালে পাড়ি দেন বিলেতে আইন পড়ার উদ্দেশ্যে।

বিলেতে পৌছে সাভারকর ব্যারিস্টারি পড়তে ভর্তি হন “Grays Inn Law College” এ । এরই পাশাপাশি চালু থাকে তার রাজনৈতিক কর্মকান্ড। বিলেতে পৌঁছানোর কয়েক মাসের মধ্যেই সাভারকর মারাঠি ভাষায় অনুবাদ করে ফেলেন ইতালীর সংযুক্তিকরণ আন্দোলনের অন্যতম নায়ক মাৎসিনির জীবনী। এরপরেই লিখে ফেলেন সিপাহি বিদ্রোহের উপর তার বহু চর্চিত বই ‘ Indian War of Independenc, 1857’। বইটির মারাঠি সংস্করণের পান্ডুলিপির কয়েকটি পৃষ্ঠা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের হাতে চলে আসায় ইংরেজি সংস্করণটি ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশ করা সম্ভব হয় না।পরে, হল্যান্ড থেকে এক তরুন সহানুভূতিশীল সাংবাদিকের সাহায্যে ১৯০৯ সালে বইটি প্রকাশিত হয়,যেখানে লেখক হিসাবে সাভারকরের নাম থাকে না। তার বদলে লেখক হিসাবে থাকে ” An Indian Nationalist”।

সাভারকরের বিভিন্ন কার্যকলাপের ওপর বৃটিশ প্রশাসন তীক্ষ্ণ নজড় রাখছিল। এরই মধ্যে ঘটে যায় এক অভাবনীয় কান্ড। ১৯০৯ সালে মদনলাল ধিঙ্গড়া হত্যা করেন বৃটিশ সরকারের ভারত বিষয়ক মন্ত্রীর আপ্ত সহায়ক কার্জন উইলিকে। এই ঘটনা আলোড়ন ফেলে দেয় গোটা বৃটেনে। মদনলাল ধিঙ্গড়া “ইন্ডিয়া হাউসে” নিয়মিত যাতায়াত করতেন এবং বলা হতে লাগলো যে সাভারকরের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই কাজটি করেছেন। সাভারকরের বিরুদ্ধে কোন প্রত্যক্ষ প্রমান না থাকায় উনি সে যাত্রায় বেঁচে যান। এই সময়ই দেশে দামোদর সাভারকরের অগ্রজ গনেশ দামোদর সাভারকর মর্লে-মিন্টো সংস্কারের প্রেক্ষিতে বৃটিশ বিরোধী কার্যকলাপ যাতে স্তিমিত না হয়ে যায় সেই কারণে একের পর এক লেখার মাধ্যমে দেশবাসীকে বৃটিশ বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার ডাক দিতে থাকেন। এর ফলে গ্রেফতার হন গনেশ সাভারকর এবং বিচারে তার যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের সাজা হয়।গনেশ সাভারকরের সাজা ঘোষণার প্রতিশোধ নিতে “অভিনব ভারতের” সদস্য অনন্ত লক্ষন কানহেরে গুলি করে হত্যা করেন নাসিকের কালেক্টর জ্যাকসনকে। অনন্তর সাথে সাভারকরের যোগসাজশের কোন প্রমান বৃটিশ পুলিশের হাতে ছিল না। কিন্তু, কিছুদিনের মধ্যেই বৃটিশ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায় সেই ব্যক্তি যিনি প্যারিস থেকে জ্যাকসন হত্যায় ব্যবহৃত পিস্তলটি ভারতে নিয়ে গিয়েছিল। সেই ব্যক্তি রাজসাক্ষী হয়ে কবুল করে যে,আগ্নেয়াস্ত্রটি ভারতে নিয়ে যাওয়ার মূল পরিকল্পনাটি ছিল সাভারকরের। এই ঘটনার জেরে বৃটিশ পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে সাভারকার পালিয়ে যান প্যারিসে। সেখানে কিছুদিন কাটিয়ে ১৯১০ সালের মার্চ মাসে ফিরে আসেন লন্ডনে এই ভেবে যে বিষয়টি হয়তো এতদিনে থিতিয়ে গেছে। কিন্তু, লন্ডনের ভিক্টোরিয়া স্টেশনে পা দেওয়ার সাথে সাথেই সাভারকর গ্রেফতার হন। বৃটিশ পুলিশ দেখে যে যদিও অপরাধটি সংগঠিত হয়েছে ভারতে,এবং অপরাধ সংগঠিত হওয়ার সময় সাভারকর ছিলেন ইংল্যান্ডের বাসিন্দা। সেক্ষেত্রে সাভারকরের বিচার ইংল্যান্ডেই করতে হবে এবং হত্যায় ইন্ধন যোগানোর অপরাধে সাভারকরের বড়জোর দুবছর সাজা হতে পারে। এবার, বৃটিশ পুলিশ সাভারকরের ভারতে থাকাকালীন দেওয়া বিভিন্ন বক্তৃতার অনুলিপিগুলি অধ্যয়ন করে দেখে যে,যদিও আপাতদৃষ্টিতে সেগুলো তেমন অপরাধমূলক না মনে হলেও, পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সেগুলোকে নাশকতামূলক বা subversive হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে। এরপর সাভারকরকে বিচারের জন্যে ভারতে নিয়ে আসা হয়। বিলেত থেকে ভারতে যাওয়ার পথে একবার ফ্রান্সের উপকূলেে জাহাজ পৌঁছালে সাভারকর সমুদ্রে ঝাপ দিয়ে মার্সেই বন্দরে পৌঁছে যান যেখান থেকে আবার তাকে গ্রেফতার করে বৃটিশ পুলিশ। এই নিয়ে বৃটেন আান্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে বলে আান্তর্জাতিক আদালতেও নালিশ জানানো হয়।সাভারকরকে দেশে ফিরিয়ে এনে দ্রুত তার বিচার সমাপ্ত করে তাঁকে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের সাজা শোনানো হয়। সাভারকরের বিচারের নামে সেদিন যা হয়েছিল তাকে প্রহসন বললেও কম বলা হয়।

সেদিন সাভারকরের গ্রেফতার ও বিচার নিয়ে দেশে বিদেশে এক অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। রাতারাতি এই সাতাশ বছরের যুবক একাধারে জাতীয় নায়ক এবং ঔপনিবেশিক বৃটিশ শাসনের নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এক আন্তর্জাতিক প্রতীকে পরিণত হন। ইতালির সংসদ এবং রিপাব্লিকান পার্টি ১৯১০ সালের আগষ্ট মাসে সাভারকরের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করে। বিদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সাভারকরের মুক্তির দাবিতে প্রবন্ধ ছাপা হয়। খোদ লন্ডনের বুকে তৈরি হয় সাভারকর মুক্তি কমিটি। বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে সাভারকরের মুক্তির জন্যে কুটনৈতিক প্রয়াস চালানো হয়। বৃটিশ সরকার কিন্তু নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল থেকে সাভারকরকে দুটি মামলায় ২৫ বছর করে মোট ৫০ বছরের দ্বীপান্তরের সাজা দেওয়া হয়। প্রথম মামলাটি ছিল নাসিকের কালেক্টর জ্যাকসন হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগ সংক্রান্ত আর দ্বিতীয় মামলাটি ছিল ভারত সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার ষড়যন্ত্র বিষয়ক। প্রথম মামলাটির রায় ঘোষণা হয় ২৪শে ডিসেম্বর, ১৯১০, এবং দ্বিতীয় মামলার রায় হয় ৩০শে জানুয়ারি, ১৯১১। ১৯১১র ৪ঠা জুলাই সাভারকরকে আন্দামানের কুখ্যাত সেলুলার জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। আর এখান থেকেই শুরু হয় বিনায়ক দামোদর সাভারকরের জীবনের এক নতুন অধ্যায়।

আন্দামানে পৌছানোর আগেই সাভারকরের পক্ষ থেকে দরখাস্ত করা হয় তার সাজা লাঘবের জন্যে, কিন্তু তা ১৯১১সালের ৪ঠা এপ্রিল খারিজ হয়ে যায়। আন্দামানে পৌছানোর মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই ১৯১১র ৩০শে আগষ্ট সাভারকর ক্ষমা প্রার্থনা করে তার প্রথম আবেদন পত্রটি লেখেন যা ৩রা সেপ্টেম্বর, ১৯১১য় খারিজ হয়ে যা। এরপর অনুরূপ ক্ষমাভিক্ষা করে সাভারকর আরও চারটি আবেদন পত্র লেখেন ১৯১৩, ১৯১৪,১৯১৮ এবং ১৯২০ সালে। দুর্ভাগ্যবশতঃ সাভারকরের লেখা ১৯১১, ১৯১৪, এবং ১৯১৮সালের ক্ষমাভিক্ষার আবেদনগুলি আজ আর পাওয়া যায় না যদিও বিভিন্ন সরকারি নথিতে এই আবেদনপত্রগুলির উল্লেখ পাওয়া যায়। এই আবেদনপত্রগুলির মধ্যে সর্বাধিক আলোচিত যে দুটি আবেদনপত্র, সেই ১৯১৩ এবং ১৯২০ সালের সাভারকরের Marcy Petition -দুটির ওপর আলোকপাত করা যাক ঃঃ

১৯১৩ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে গভর্নর জেনারেল কাউন্সিলের স্বরাষ্ট্র বিষয়ক সদস্য স্যার রেজিনাল্ড ক্রফোর্ড আন্দামান সেলুলার জেল পরিদর্শনে আসেন। সাভারকর ১৯১৩ সালের ১৪ই নভেম্বর স্বহস্তে তার ক্ষমাভিক্ষাপত্রটি স্যার ক্রফোর্ডের হাতে দেন। সেই আবেদনপত্রে সাভারকর লিখেছেন যে যদিও তার সাথে তার “দলের” অন্যান্য সদস্যদেরও একই অপরাধে সেলুলার জেলে বন্দি করা হয়েছে, তবুও তার প্রতি কারা কর্তৃপক্ষের আচরণ চুড়ান্ত বৈষম্যমূলক। তার সতীর্থদের তুলনায় তার ওপর অনেকবেশি নিপীড়ন চালানো হয়, তাকে ‘D’ শ্রেণীর বন্দী আখ্যা দিয়ে দীর্ঘ ছয় মাস একাকী একটা খুপরিতে বন্দী করে রাখা হয়। তার শ্রেণী বদলের আবেদনপত্র খারিজ করে দেওয়া হয়। ভাল খাবার চাইলে তাকে বলা হয় যে তিনি একজন সাধারণ শ্রেণীর বন্দী এবং তার জন্য যা বরাদ্দ তাই তাকে খেতে হবে। তার অন্যান্য সতীর্থ বন্দীদের বাইরে যেতে দেওয়া হলেও তাঁকে সেই সুযোগ দেওয়া হয় না উল্টে তাঁকে একাধিকবার বেত্রাঘাত করা হয়। অবশেষে কর্তৃপক্ষ যখন তাঁকে বাইরে যাবার অনুমতি দেয়, ঠিক সেইসময় কিছু রাজনৈতিক বন্দী গন্ডগোল করায় তাঁকে পুনরায় অন্তরীণ করা হয়। তাঁকে ভারতের মুল ভুখন্ডের কোন জেলে বন্দী করা হলে তিনি অনেক বেশী স্বাধীনতা পেতেন, বাড়িতে আরও বেশি চিঠি লিখতে পারতেন…,……… ইত্যাদি। উনি আরও উল্লেখ করেন যে উনি ১৯১১সালে ক্ষমা প্রার্থনা করে একটি আবেদনপত্র দিয়েছিলেন।সাভারকর লেখেন যে ভারতের অবস্থা তখন অনেকটাই বদলে গেছে আর তেমন সময়ে বিপ্লবের কণ্টকাকীর্ণ পথে চলাটা মুর্খতা। বরং সরকার বাহাদুরের আপোষকামী মনোভাব সাংবিধানিক পথে সব সমস্যার নিরসনের উপায় করে দিয়েছে। এরপরে তিনি লিখছেন যে,তাঁকে মুক্তি দিলে ভারতের আপামর জনতা যাঁরা মুলতঃ সরকার বাহাদুরের অনুগত প্রজা, তারা সরকার বাহাদুরের নামে জয়ধ্বনি দেবেন। এই আবেদন পত্রের শেষে সাভারকর লিখেছেন, “I am ready to serve the Government in any capacity they like, for as my conversion is conscientious so I hope my future conduct would be. By keeping me in jail nothing can be got in comparison to what would be otherwis. The Mighty alone can afford to be merciful and therefore where else can the prodigal son return but to the parental doors of the Government ?? Hoping your Honour will kindly take into notion these points.”এখানে সাভারকর যা লিখেছেন তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। উনি লিখেছেন যে,মুক্তি পেলে উনি সরকারের সেবা করতে চান এবং ওর এই কনভার্সন বা হৃদয় পরিবর্তন বিবেকের তাড়নায়। এ ছাড়াও উনি বলেছেন যে “Prodigal Son” বা বেপথু সন্তান তার পিতামাতা ছাড়া আর কার দুয়ারে যাবে ?

১৯২০ সালের ৩০-শে মার্চ সাভারকার তাঁর পঞ্চম (১৯১১র আবেদনটি ধরলে ষষ্ঠ) আবেদনটি দেন আন্দামানের তদানিন্তন চিফ কমিশনারকে। এই আবেদনে বৃটিশ রাজশক্তির কাছে সাভারকারের আত্মসমর্পনের ভাব পূর্ণরুপে প্রকাশ পায়। এই আবেদনে সাভারকার লেখেন যে সরকার বাহাদুর সেইসব আইনভঙ্গকারী যারা রাজনৈতিক উন্নতি প্রয়াসী তাদের করুনাময়তা প্রদর্শনের যে নীতি গ্রহণ করেছেন সেই নীতির সাথে তাঁর এবং তাঁর অগ্রজ গনেশ সাভারকারের বিষয়টি সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেহেতু সরকার করুনাময়তা প্রদর্শনের বা clemency-র নীতিতে কোনো অপরাধ কে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হয় নি সেই হেতু তাদের বিষয়টিও এই নীতির প্রেক্ষিতে বিবেচিত হওয়া উচিত। তদুপরি সরকার বাহাদুর ইতিমধ্যেই মানিকতলা বোমা মামলায় অভিযুক্ত বারীণ ঘোষ আর হেমচন্দ্র কানুনগো কেও এই একই নীতির ভিত্তিতে মুক্তি প্রদান করেছে। তাঁদের দুই ভাইয়ের ( বিনায়ক এবং গনেশ সাভারকর) কারুরই সরকার বাহাদুরের বিরুদ্ধে কোন ক্ষোভ নেই। তাঁর সম্মুখে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ পড়ে আছে। সেসব ত্যাগ করে কোন বিপজ্জনক পথে পদচারণা করার ইচ্ছে তাঁর নেই। এমনকি (পিটার) ক্রোপোটকিন বা (লিও) টলস্টয় বর্ণিত শান্তিপূর্ণ দার্শনিক নৈরাজ্যবাদেও তিনি বিশ্বাসী নন। সাভারকার আরও লিখছেন যে তিনি তাঁর ১৯১৪ সালের ক্ষমা প্রার্থনার আবেদনটিতে জার্মান-তুর্কি- আফগানিস্তান দ্বারা ভারতে আক্রমণ চালানোর সম্ভাবনার প্রেক্ষিতে বৃটিশ সরকারকে সবরকমের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিলেন এবং তাঁর ১৯১৮ সালের আবেদনপত্রে (বৃটিশ সরকারের তৎকালীন ভারত বিষয়ক মন্ত্রী)মন্টেগু সাহেবের উদ্যোগে ভারতের যে নতুন সংবিধান রচিত হচ্ছে তার প্রতি পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করে সাংবিধানিক পথে চলার অঙ্গীকার তিনি করেন। এছাড়াও তিনি মনে করিয়ে দেন যে ভারত তখন ধর্মান্ধ (fanatic) তুর্কি- আফগান শক্তির বিরুদ্ধে লড়ছে এবং এমন এক সময়ে তাঁর মত একজন অনুগত প্রজাকে মুক্তি দিলে আখেরে সরকার বাহাদুরেরই লাভ হবে। সব শেষে তিনি লেখেন যে চিফ কমিশনার সাহেব নিশ্চয়ই মনে রেখেছেন যে,শত দুর্ব্যবহার সত্বেও সাভারকার সর্বদাই তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এসেছেন।এখানে আরও একটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়, আর তা হলো এই যে সাভারকার যখন বিলেতে পড়তে যান তখন তিনি বিবাহিত। ১৯১৫ সালে সাভারকরের স্ত্রী তার স্বামীর মুক্তির জন্য একটি আবেদন করেন যা খারিজ হয়ে যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে বিনায়ক দামোদর সাভারকারকে ১৯২১ সালের ২রা মে আন্দামান সেলুলার জেল থেকে মুক্তি দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বোম্বাই (অধুনা মহারাষ্ট্র) প্রদেশের রত্নাগিরি জেলার ইয়েরাওয়াড়া জেলে যেখানে উনি ১৯২৪ সালের ৬ই জানুয়ারি পর্যন্ত অন্তরীণ থাকেন। এরপর তাঁকে মুক্তি দেওয়া হলেও তিনি রত্নাগিরি জেলার বাইরে যাওয়ার অনুমতি পান না, তবে উনি পরিবারের সাথে থাকতে পারেন এবং রত্নাগিরি জেলার মধ্যে স্বাধীনভাবেই বিচরণ করার অধিকার পান। বস্তুত, সাভারকারকে আন্দামান সেলুলার জেলে দশ বছরেরও কম সময় কাটাতে হয়।

সাভারকার কিন্তু তার মুক্তির এই শর্তগুলো নির্দ্ধিধায় মেনে নিয়েছিলেন। রত্নাগিরি জেলায় থাকার পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পরেও যখন তাকে জেলার বাইরে যেতে দিতে অস্বীকার করে সরকার তখন সাভারকার সরকারের কাছে মাসোহারা দাবি করেন এবং মাসিক ষাট টাকা মাসোহারা তাঁর জন্য ধার্য করে বৃটিশ সরকার। এর দুবছর পর সাভারকারকে পূর্ণ মুক্তি দেওয়া হয় এই শর্তে যে উনি জীবনে কখনো কোন রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণ করবেন না।এই মুচলেকাতেও সাভারকার সই করেন। অথচ, যখন সাভারকার “হিন্দু মহাসভায়” যোগ দেন এবং সংগঠনটির শীর্ষপদ অলঙ্কৃত করেন তখন কিন্তু বৃটিশ সরকার তাঁকে বাধা দেয় নি।

সাভারকারের এই ক্ষমাপ্রার্থনা নিয়ে আজ অনেকরকম যুক্তি দেওয়া হচ্ছে আর এই ধরনের ক্ষমাপ্রার্থনার ঔচিত্য নিয়ে প্রশ্ন তুললেই “দেশদ্রোহী” বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে ক্ষমা প্রার্থনা আসলে সাভারকারের একটি “রাজনৈতিক কৌশল”। এ বিষয়ে আরএসএসের বক্তব্য হলো এই যে ছত্রপতি শিবাজীর আদর্শের একজন একনিষ্ঠ অনুগামী হিসাবে সাভারকার শত্রুর সাথে আপোষ অপেক্ষা যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া শ্রেয় মনে করতেন। কিন্তু জেলে অন্তরীণ থাকলে তো যুদ্ধটাই করা যাবে না। তাই, অন্য কোন উপায় না দেখে উনি ও-ই ছয়টি চিঠি লিখেছিলেন বৃটিশ সরকারের কাছে তার মুক্তির আর্জি জানিয়ে। আরএসএসের তরফ থেকে আরও লেখা হয় “উনি ছিলেন সৈনাপত্যে দক্ষ একজন ব্যাক্তি। উনি দেখেছিলেন যে, জাতি যখন বৃটিশ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করছে তখন বৃটিশ জেলে বন্দি থেকে অত্যাচারিত হয়ে জীবনের অমুল্য সময় ব্যয় করা অর্থহীন। বৃটিশ জেল থেকে মুক্তি পেয়ে দেশের মুক্তিসংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ার মহৎ উদ্দেশ্যে সাভারকারের ক্ষমাভিক্ষা অবশ্যই সমর্থনযোগ্য।” অথচ মুক্তি পাওয়ার পর বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে কোন সংগ্রামেই সাভারকারকে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায় না, বরং বিভিন্ন সময়, বিশেষকরে ১৯৪২এর মহাসংগ্রামের সময় তাকে বৃটিশ রাজশক্তির পক্ষ অবলম্বন করতে দেখা যায়।

এবার দেখা যাক সাভারকার যখন তার এই বহুচর্চিত ক্ষমাভিক্ষার আবেদনগুলি লিখছিলেন তখন আন্দামানের অন্য বন্দীরা কি করছিলেন। সাভারকর যখন বন্দী হয়ে আন্দামান সেলুলার জেলে আসেন,সেই সময় সেখানে কারারুদ্ধ ছিলেন মানিকতলা বোমা মামলায় অভিযুক্ত উল্লাসকর দত্ত, বারীন ঘোষ,ডালহৌসি স্কোয়ারের বোমা মামলার ননি গোপাল মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বাংলার অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা। এদের মধ্যে একমাত্র বারীণ ঘোষই নিজের মুক্তি চেয়ে দরখাস্ত করেছিলে। কিন্তু তার দরখাস্তের ভাষা সাভারকারের মত নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের ছিল না। এ ছাড়াও দরখাস্ত করেছিলেন হৃষীকেশ কাঞ্জি লাল। তবে সেই দরখাস্ত মোটেও তাঁর নিজের মুক্তির জন্যে নয়। সেই দরখাস্ত ছিল সেলুলার জেলে বন্দীদের প্রতি মানবিক আচরণের দাবি জানিয়ে। উল্লাসকর দত্তর উপর সেলুলার জেলে অকথ্য অত্যাচার চালানো হয়। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের রচনা থেকে পাওয়া যায় যে এই অত্যাচারের ফলে তিনি পাগল হয়ে যান।ওনাকে মুক্তি না দিয়ে মাদ্রাজের মানসিক রোগিদের হাসপাতালে বন্দী করে রাখা হয়। অবশেষে ওনার ১৪ বছর কারাবাসের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পরেই উনি মুক্তি পান। উল্লাসকর দত্ত কিন্তু তার এই দীর্ঘ কারাবাসের সময় একবারের জন্যও ক্ষমা প্রার্থনা করে কোনও আবেদন করেন নি। বিপ্লবী ইন্দুভূষণ রায়ের যাবজ্জীবন সাজা হয়েছিল। উনি যথেষ্টই সাহসী এবং বলিষ্ঠ শারীরিক এবং মানসিক শক্তির অধিকারী ছিলেন।শারীরিক শ্রমে কখনোই ভীত ছিলেন না। কিন্তু, উনি অবমাননাকর ব্যবহার সহ্য করতেন না। এই মনোভাবের জন্য তাঁর ওপর এমন অত্যাচার চালানো হয় যে একদিন সহ্য করতে না পেরে উনি নিজের কুঠুরিতে আত্মহত্যা করেন। বিপ্লবী ইন্দুভূষণ রায়ও কোনদিনই ক্ষমাপ্রার্থনা করেন নি। পুলিন বিহারি দাস ছিলেন আরেকজন বিপ্লবী যিনি শত অত্যাচারেও ভেঙে পরেন নি বা ক্ষমা চান নি। তাই, ১৯১৪ সালে যখন তার সাথে একই অভিযোগে অভিযুক্তদের দেশের মূল ভূখণ্ডের বিভিন্ন কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয়, তখন পুলিন বিহারি দাস কে আন্দামানেই রেখে দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে গভর্নর জেনারেলস কাউন্সিলের স্বরাষ্ট্র বিষয়ক সদস্য, স্যার রেজিনাল্ড ক্রফোর্ড তাঁর ৬ই জানুয়ারি, ১৯১৪র নোটে লেখেন,”আমি যখন সেলুলার জেল পরিদর্শনে যাই তখন অনেকে আমার সাথে কথা বলে। কিন্তু ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত পুলিন বিহারি দাস একটিও কথা বলেন নি। অন্যদের মূল ভূখণ্ডে ফিরিয়ে আনলেও একটি ক্ষেত্রে তার ব্যাতিক্রম হয় আর তা হলো পুলিন বিহারি দাস। আমি ওঁকে আন্দামানে রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছি। ” ননি গোপাল মুখোপাধ্যায়কে যখন যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের সাজা শোনানো হয় তখন তিনি মাত্র ১৬ বছরের কিশোর। ১৯১২সালে বোমা ছোড়ার পর এই অসমসাহসী কিশোর পালিয়ে যান নি। স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছিলেন পুলিশের হাতে। তাঁর আশা ছিল যে,ক্ষুদিরামের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁরও ফাঁসির হুকুম হবে। কিন্তু যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের সাজা হয়। সেই সময়ই আন্দামানে বন্দীরা রাজনৈতিক বন্দীর মর্যাদা পাওয়ার দাবীতে অনশন শুরু করেন। এই দাবীর প্রতি সহমত পোষণ করেও বিনায়ক দামোদর সাভারকার এবং তাঁর অগ্রজ গনেশ সাভারকার এই অনশনে যোগ দেন নি। মাত্র ১৬বছরের কিশোর ননী গোপাল মুখোপাধ্যায় এই অনশনে যোগ দেন। কারা কর্তৃপক্ষ অনেক রকম দমন-পীড়ন চালায় এই অনশন বন্ধ করতে। খাবার জলের জায়গায় দুধ রেখে দেওয়া, জোড় করে খাদ্য গেলানোর চেষ্টা- এ-সবতো ছিলই, তার সাথে চলতো নির্মম বেত্রাঘাত ইত্যাদি। এই আন্দোলনে সবচেয়ে বেশী দৃঢ়তার পরিচয় দেন ননী গোপাল মুখোপাধ্যায়। কারা কর্তৃপক্ষ তাঁর হাতেপায়ে বেড়ি বেঁধে ঘন্টার পর ঘন্টা রোদে দাঁড় করিয়ে রাখে,তাঁকে জামা-কাপড়ের জায়গায় চটের তৈরি পোষাক দেওয়া হয় যা পরতে অস্বীকার করায় তার দেহে শুকনো নারকেলের ছোবা ঘষে তাঁকে রক্তাক্ত করা হয়।এই সময় ননী গোপালের একটাই কথা ছিল যে তিনি খাবারের জন্য লড়ছেন না, লড়ছেন আত্মসম্মানের জন্যে। তাঁরা রাজনৈতিক বন্দী, কোন চোর-ডাকাত নন।তাই সম্মানজনক ব্যবহার তাঁদের প্রাপ্য। অনশনের ফলে তাঁর শরীর নিস্তেজ হয়ে আসে। তবুও কি অদম্য ইচ্ছাশক্তি। তাঁকে জোর করে খাওয়ানোর সবচেষ্টা বিফল হলে তাঁর নাকে নল ঢুকিয়ে দুধ ঢেলে দেওয়া হয়। তখনই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন এই কিশোর বীর ননী গোপাল মুখোপাধ্যায়। সাভারকার সেলুলার জেলে থাকাকালীনই সেখানে বন্দী হয়ে আসেন বাঘাযতীনের অন্যতম সহযোগী জ্যোতিষ চন্দ্র পাল। অকথ্য অত্যাচারের ফলে উনি উন্মাদ হয়ে যান। তখন ওনাকে স্থানান্তরিত করা হয় ওড়িশার বেরহামপুর জেলে। সেখান থেকে মানসিক হাসপাতালে। সেই মানসিক হাসপাতালেই ১৯২৪সালের ডিসেম্বরে ওনার মৃত্যু হয়। ১৯১৬ সালে আন্দামানে বন্দী হয়ে আসেন ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী। বিপ্লবী মহলে উনি “মহারাজ” বলে পরিচিত ছিলে। মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী বহুবার জেল যাত্রা করেন এবং আন্দামানে উনি ১৯১৬ থেকে ১৯২১ পর্যন্ত অন্তরীণ ছিলেন। ওনার জেল জীবনের আলেখ্য “জেলে ত্রিশ বছর” এ আন্দামানে তাঁর সমসাময়িক বহু ঘটনা বিদ্ধৃত আছে। উনি লিখেছেন যে, আন্দামানে পৌঁছে উনি দেখেন সাভারকর, বারীন ঘোষরা এর আগে যথেষ্ট নিপীড়ন সইলেও তখন তারা জেল সুপারের বেশ প্রিয় পাত্র এবং অন্যান্যদের তুলনায় তারা কিছু বেশী সুযোগ সুবিধা পান। এর ফলে যখন মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীরা তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতনের প্রতিবাদ করেন তখন অবাক হয়ে দেখেন যে সাভারকার এবং বারীনবাবু তাদের সেই সুযোগ সুবিধাগুলো ত্যাগ করে এই সংগ্রামে যোগ দিতে অস্বীকার করছেন। এই ঘটনাটি তাঁকে অত্যন্ত ব্যথিত করেছিল সেদিন।ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে এই ঘটনা সাভারকারের মত ‘বিপ্লবীর’ পক্ষে মোটেও গরিমার বিষয় ছিল না। এই অসহনীয় অবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়েও আন্দামানের বিপ্লবী বন্দীরা তাদের বন্দী জীবনে নিরন্তর সংগ্রাম করেছেন, আত্মাহুতি দিয়েছেন, মারের পাহাড় পেরিয়েছেন। শত শত তরুন আন্দামানে পৌঁছনোর কয়েকদিনের মধ্যেই অকাল বার্ধক্যের শিকার হয়েছিলেন। তবুও তারা মাথা নোয়াননি। শত প্রতিকূলতার মধ্যে দাঁড়িয়ে তারা তাদের লড়াই চালিয়ে গেছেন। এরই মধ্যে তারা চালু করেন একটি লাইব্রেরী, এমনকি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলেন জেলের অভ্যন্তরে।

সাভারকারের মুক্তির পরই প্রকাশিত হয় একটি বই যার শীর্ষক ছিল, ” The Life of VEER SAVARKAR “। বইটির লেখক কোন এক “চিত্রগুপ্ত “। অনেক পরে জানা যায় যে এই “চিত্রগুপ্ত” আর কেউ নন, বিনায়ক দামোদর সাভারকার স্বয়ং। এই বইটি প্রকাশের পরে তা ভালোই বিক্রি হয় এবং বৃটিশ সরকার এই বইটির প্রকাশ এবং বিক্রিতে কোনরকমের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে নি। এর পরই সাভারকারের নামের আগে বীর উপাধিটি বসে যায়, যা বস্তুত তাঁর নিজেরই দেওয়া। এর পরের ইতিহাস সবারই জানা। আধুনিক ভারতের রাজনীতিতে সাভারকার তাঁর জীবনের প্রথম অধ্যায়টি ছাড়া তাঁর জীবদ্দশায় তেমন দাগ না কাটতে পারলেও, তিনি যে বিভাজনের বিষবৃক্ষ বপন করেছিলেন তা আজ শাখাপ্রশাখা মেলে মহিরুহে পরিনত হয়েছে। আজ তাঁর সেই দর্শন আধুনিক ভারত রাস্ট্রের মূল ভিত্তিতে এমন আঘাত হেনেছে যে ভারতবর্ষের যে ধারনা স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারা থেকে সৃজিত হয়েছিল তাই আজ ধ্বংসের মুখে।

( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

ছবিঃ গুগল থেকে সংগৃহীত

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *