মনিপুরও কি ঘটানো হয়েছে???—————-

ভারতবর্ষের লোকসভা পরিচালন পদ্ধতির যে নিজস্ব লিপিবদ্ধ নিয়মাবলী রয়েছে, তার রুল ১৯৮ অনুযায়ী কেন্দ্রের বর্তমান মোদী সরকারের বিরুদ্ধে একটি “নো কন্ফিডেন্স মোশান” বা অবিশ্বাস প্রস্তাব আনা হয়েছে। এই নিয়মাবলী অনুযায়ী প্রস্তাবক ছাড়াও প্রস্তাবের সপক্ষে আরও ৫০ জন সাংসদের সাক্ষরিত সমর্থনও রয়েছে। এখন প্রয়োজন শুধুই মহামান্য স্পীকারের প্রয়োজনীয় সম্মতি এবং এই প্রস্তাবের ওপর আলোচনা এবং ভোটাভুটির দিনক্ষন ঠিক করা। অথচ আমরা বিগত কয়েকদিনে দেখলাম অবিশ্বাস প্রস্তাবটির ওপর স্পীকার মহোদয়ের দ্বারা আলোচনার জন্য কোনো দিনক্ষন ঠিক করা হলোনা। বিভিন্ন টালবাহানায় সমগ্র বিষয়টিই এক ধোঁয়াশার শিকার। অথচ এর মধ্যেই সরকার কিছু বিল পাশ করিয়ে নিচ্ছে। যেটা ক্রমেই পরিস্কার হচ্ছে যে সরকার সংসদে এই অবিশ্বাস প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা এড়াতে চায়। এর প্রধান কারন হলো সরকার পক্ষের কাছে আজ এটা পরিস্কার যে এই অবিশ্বাস প্রস্তাবের প্রধান উদ্দেশ্য হলো যে সম্মিলিত বিরোধী পক্ষ আসলে এই প্রস্তাবকে উপলক্ষ করে অন্যান্য বিষয়গুলির সাথে প্রধানত মনিপুরের সাম্প্রতিক ও বর্তমান অবস্থার বিষয়কেই আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু করবে, এবং মোদী সরকার এই মূহুর্তে এই সংক্রান্ত আলোচনায় যেতে আদৌ রাজি নয়।এখন প্রশ্ন হলো মোদী সরকার বার বার মনিপুর নিয়ে আলোচনায় নিজেরাই রাজি বলার পরেও সংসদে এই ব্যাপারে বিশদ আলোচনায় কেন আগ্রহী নয়। কেন সরকার লোকসভার নিয়মাবলীর রুল ২৬৭ অনুযায়ী দিনের সমস্ত বাকি আলোচনা বন্ধ রেখে মনিপুর নিয়েই শুধু আলোচনায় এবং তার পর ভোটাভুটিতে রাজি নয়, বরং তার বদলে রুল ১৭৬ অনুযায়ী স্বল্প মেয়াদি আলোচনায় জন্য বার বার বিরোধীদের চাপ দিচ্ছে, যাতে ভোটাভুটি এড়ানো যায়।এইসব দীর্ঘসূত্রতার প্রয়াস ছাড়াও মোদী সরকার মনিপুর নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিভেদকামী অবস্থান নিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী মোদী তার প্রায় ৭৯ দিনের মৌনতা ভেঙ্গে মনিপুর নিয়ে ৩৬ সেকেন্ডের ব্যক্তব্য জানালেন, তাও সেটা রাজস্থান এবং ছত্তিসগড়ের উদাহারন টেনে, অর্থাৎ মনিপুর নিয়ে নয়, তার প্রধান উপজীব্যই ছিলো রাজস্থান ও ছত্তিসগড়ের প্রসঙ্গ টানার অজুহাতে মনিপুরকে উল্লেখ করা। সরকার সংসদে এইসব আলোচনা না করতেই উদগ্রীব কেননা তাতে যে সত্য উঠে আসবে যে রাজস্থান ও ছত্তিসগড়ে কংগ্রেসের রাজ্যসরকার ঘটনাগুলি ঘটার ২৪ ঘন্টার মধ্যেই এফআইআরে নাম থাকা প্রধান অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। অপরদিকে মনিপুরে বিজেপির রাজ্যসরকার শুধুমাত্র প্রথম ৭৫ দিনে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি শুধু নয়, এইসব নারকীয় ঘটনাক্রমের পেছনে তাদের মদত থাকার অভিযোগও ক্রমবর্ধমান। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডবল ইঞ্জিনের আর এক পক্ষ মোদী সরকারের নীরবতা এবং পরোক্ষ মদতের অভিযোগ। এই সব অভিযোগের সত্যসত্য নিরুপনের সুযোগ মোদী সরকার বিরোধীদের দিতে কখনই রাজি নয়, বিশেষ করে সম্মিলিত বিরোধীপক্ষের I.N.D.I.A. নামক সম্মিলিত প্রয়াসের পরবর্তীতে।অভিযোগ উঠছে বিজেপির চিন্তা অবিশ্বাস প্রস্তাবের আলোচনার সময় মনিপুরের সাম্প্রতিক ডবল ইঞ্জিনের সরকারগুলির আরোপিত ব্যার্থতার কালো সত্য সংসদের মাধ্যমে জনমানসে ছড়িয়ে পড়বে। আলোচনায় উঠে আসতে পারে সঙ্ঘ পরিবারের দীর্ঘ দিনের প্রয়াস হিন্দু ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর মেইতেইদের খৃষ্টান ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর কুকিদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের অভিযোগ। আরও অভিযোগ কুকিদের বাসস্থান পাহাড়ি বনাঞ্চল থেকে তাদের বিতাড়ন, যাতে পাহাড় সমেত জঙ্গল ও জমি পরিচিত পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়া যায়। অভিযোগ নাকি যার ফল সাম্প্রতিক সময়েই শুধু ৪০ টির মতো গীর্জা পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা, যা হাইকোর্টের সংরক্ষণ নিয়ে আদেশের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জাতিগোষ্ঠীগত দাঙ্গায় নাকি অনুঘটকের কাজ করেছে। মনিপুরের মতো একটি সংবেদনশীল সীমান্তবর্তী রাজ্যের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমন্ডলে এই বিভেদমূলক অপচেষ্টা এক দীর্ঘকালীন প্রতিক্রিয়ার ছাপ ফেলে গেছে বলেই জনমানসে সন্দেহ, যার সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া থেকেই যাবে, বিশেষ করে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মনিপুরে বিভিন্ন কঠিন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়েছে এবং দীর্ঘ প্রক্রিয়ার শেষে মনিপুর জাতীয় মূলধারায় প্রতিস্থাপিত হয়েছে।সাম্প্রতিক সময়েও যে ভিডিও অংশটি সামাজিক মাধ্যমে বহুল প্রচারিত, সেটি না ঘটলে মনিপুরে মহিলাদের ওপর অত্যাচারের কথা দেশ জানতেই পারতোনা এবং প্রধানমন্ত্রীও মনিপুর নিয়ে ছুঁয়ে যাওয়া দায়সারা ব্যক্তব্য রাখতেননা। এই পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনায় আরো যে সব অভিযোগ ও সত্য ঘটনা দিনের আলোয় আসতো, তাও বিজেপির রাজ্য এবং কেন্দীয় সরকারের মুখোশ খুলো দিতো। তাই কি এই আলোচনা এড়িয়ে যাওয়ার প্রাণান্তকর প্রয়াস বিজেপির?ঘটনা হলো ভাইরাল ভিডিওয় নারীত্বের অত্যাচার সওয়া দুজন মনিপুরী মহিলার মধ্যে একজনকে দিল্লির এইমস্ এ চিকিৎসার জন্য আনা হয়েছিলো। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর ঐ অত্যাচারিতা মহিলা রাজধানী দিল্লির গৌতম নগর পুলিস স্টেশনে একটি “জিরো এফআইআর” দায়ের করেন। এরপর মনিপুরে ফিরে আবারও এফআইআর করেন। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ মনিপুরে গিয়ে তিন দিন ছিলেন। ভাবা যায় মোদী সরকারের হাতে থাকা দিল্লি পুলিসের কাছে এফআইআর হওয়া সত্বেও ভিডিও ভাইরাল হওয়ার আগে রাজ্য সরকার ও তার প্রশাসন চুপচাপ বসে ছিলো, কোনো ব্যবস্থাই গ্রহন করেনি। মনিপুর নিয়ে আলোচনা হলে এই সমস্ত ঘটনা লোকসমক্ষে আসবেই। আলোচনা হলে এই অভিযোগও মানুষ আরও জানবে যে এই দুই কুকি মহিলাকে মেইতেইদের ভীড়ের হতে তুলে দিয়েছিলো বিজেপি রাজ্য সরকারের পুলিস নিজেরাই। কতবড় নির্লজ্জ হলে একজন মুখ্যমন্ত্রী বলতে পারেন এমন মহিলাদের ওপর অত্যাচার একশোর বেশি সংখ্যায় ঘটেছে। এটা সভ্যতার অপমান যে এতো কিছুর পরও একজন মুখ্যমন্ত্রী তার গদীতে এখনও আসীন। লজ্জাজনক অবস্থান জাতীয় মহিলা কমিশনেরও। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এরপরেও রাজস্থান, ছত্তিশগড়ের ঘটনা টেনে মনিপুরের ঘটনাগুলিকে মান্যতা দিতে চাইছেন। প্রশ্ন হলো মনিপুরে ৩৫৫ ধারা জারি করলেও, রাজস্থান বা ছত্তিসগড়ে তা করা হয়নি। এটাই প্রমান করে মনিপুরের সঙ্গে ঐগুলির কোনো তুলনাই চলেনা।

পার্থ মুখোপাধ্যায়।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *