মণিপুরের মন কি বাত

মূল ইংরেজি রচনাঃ অধীর রঞ্জন চৌধুরী।

( বাংলায় ভাবানুবাদঃ পার্থ মুখোপাধ্যায়)

( মূল নিবন্ধটি গত ৪ অগাস্ট ‘২৩,The Indian Express ‘- এ প্রকাশিত)

পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম্য এলাকায় রাজনীতি করার সুবাদে এবং একজন বিরোধী পক্ষের জনপ্রতিনিধি হিসাবে মহিলা, পুরুষ এবং শিশুরা রাজনৈতিক হিংসার দ্বারা কি ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা আমি স্বচক্ষে দেখেছি। সেইসব হিংসার পেছনে সাম্প্রদায়িক, জাতিগত, সামাজিক শ্রেণীবিভাগ বা ভৌগোলিক, যাই কারন থাকুক, কিন্তু আমাদের সাম্প্রতিক মনিপুরের উপদ্রুত অঞ্চলসমূহ পরিদর্শন করে রাষ্ট্রপতি মহোদয়ার নিকট আমাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করার পর বুকে হাত রেখে নির্দ্বিধায় বলতে পারি, মনিপুরের ঘটনাবলী সম্পূর্ণ পৃথক এবং বর্তমান সময়ের জন্য এক অভাবনীয় চ্যালেঞ্জ।

মৃত্যুর সংখ্যা ১৫০ ছুঁয়েছে এবং সম্পত্তির ওপর আক্রমন ও হিংসার ফলে অগুণিত বাড়ি ধ্বংস হয়েছে। সম্পদের এবং জীবন জীবিকার ব্যাপক ধ্বংস ও ক্ষতি সাধিত হয়েছে। এর চেয়েও অনেক বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে আরো একটা অন্য কারণে। রাজ্যের দুটি ভাগে বিভক্ত হওয়ার কারণে যখন নাগরিকেরা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য তাঁদের পরিচয়কে ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছেন এবং সেই পরিচয়ই আবার তাঁদের বিপদের কারণ হয়েছে। এইসব ঘটনার মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো সরকার এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শাসন ব্যবস্থা হতে বিযুক্ত হওয়া। ১৯৯০ এর দশকে নাগা-কুকিদের মধ্যে সংঘর্ষ নিয়ে অনেক কথা বলা হয় যখন ৭০০র বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিলো কিন্তু রাজনৈতিক প্রচেষ্টা এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের এমন উপস্থিতিহীনতার ঘটনা ঘটেনি, যাঁদের উপস্থিতি ছাড়া গনতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা ও সংবিধানের আওতায় সমাধানের পথ নির্গত হতে পারেনা।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমার সাম্প্রতিক মণিপুর ভ্রমনের সময় এই সমস্ত বিষয় আমাদের সামনে এসেছে, যা আমাদের সকলের একীভূত ক্রোধ ও বেদনার কারণ হয়েছে। ত্রান শিবিরগুলিতে মানুষের দুর্দশা, তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা ও অবিশ্বাসের বাতাবরন এবং আপাত বিদ্যমান আশাহীনতার পরিসরে মনিপুরের মানুষের জন্য যা প্রয়োজন তা হলো এমন একজন রাজ্যের বাইরের মানুষের সান্নিধ্য যিনি অবস্থার পরিবর্তন করতে সক্ষম হবেন, তাঁদের সঙ্গে বসে তাঁদের কথা শুনবেন, তাঁদের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেবেন, তাঁদের হাতে হাত ধরবেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী এই কাজের সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি হতে পারতেন কিন্তু তিনি সম্পূর্ণ ভিন্নপথে চলছেন। নীরবতাকেই প্রধানমন্ত্রী তাঁর কর্মপদ্ধতি করেছেন। যতই প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের দাবি জোরালো হচ্ছে, ততই তিনি তার উদ্ধত অবাধ্যতার সঙ্গে নীরবতাকেই আশ্রয় করেছেন।যা ভাবনায় রাখা হচ্ছেনা, তা হলো ভারত-মায়ানমারের যৌথ ১৬৫০ কিমিঃ সীমানার মধ্যে ৪০০ কিমিঃ মনিপুরের সঙ্গে যেখানে মায়ানমারের সেনা ও সাধারণ মানুষের সংঘর্ষের কারনেই মাদক পাচার এবং বেআইনি সীমান্ত লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। চিনও হাত গুটিয়ে বসে নেই। প্রাক্তন সেনাবাহিনী প্রধান এম এম নারওয়ানের এই ব্যক্তব্যকে উড়িয়ে দেওয়া যায়না যে চিন বিভিন্ন উগ্রবাদী দলকে সাহায্য করছে।মনিমুক্তোখচিত ভূমি বলে খ্যাত মনিপুরের উপত্যকায় প্রধানত সংখ্যাগুরু মেইতেই (৬৫%) গোষ্ঠীর বাস, যার মধ্যে হিন্দু বৈষ্ণব, মুসলিম যারা পাঙ্গাল নামে পরিচিত এবং মেইতেই খৃষ্টান সম্প্রদায় রয়েছেন। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীতে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী রয়েছে, যাদের মধ্যে প্রধানত রয়েছে কুকি এবং নাগারা। এই জটিল জনবিন্যাস এবং তার কারনে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর স্বার্থের বিভিন্নতা ও আশা আকাঙ্ক্ষার দ্বন্দের কারনে সুক্ষ সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের প্রতিনিয়ত একটি দায়িত্ব ছিলো জাতি বিবাদ যেন হিংসার রূপ না নেয়।এই পরিপ্রেক্ষিতেই প্রশ্ন উঠছে রাষ্ট্র কেন চোখ বন্ধ করে রেখেছে অথবা দৃষ্টি অন্যদিকে নিবদ্ধ রেখেছে। রাজ্যের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সুদীর্ঘকালীন সমন্বয়ের এই ইতিহাসকে জেনেও কেন বিভেদের ফাটলগুলির ব্যাপ্তি ও গভীরতার বিস্তারের প্রামান্য ঘটনায়ও নির্লিপ্ত রয়েছে।

যে দুটি প্রধান ঘটনা বর্তমান সঙ্কটের জন্য দায়ি বলে ব্যাপকভাবে প্রচারিত, তা হলো প্রথমতো চূড়াচাঁদপুর জেলার কেসংজং গ্রামের গ্রামবাসীদের বনাঞ্চল সংরক্ষনের কারনে সরিয়ে নেওয়া এবং দ্বিতীয়ত মনিপুর উচ্চ আদালতের একটি রায় যা সংখ্যাগুরু মেইতেই সম্প্রদায়কে সংরক্ষিত উপজাতির মর্যাদা দেওয়ার সুপারিশ করে। এর ফলে মেইতেইদের যেমন একটি দীর্ঘকালীন দাবির পুরন হয় যা তাদের জন্য অতিরিক্ত সুযোগের সৃষ্টি করে কিন্তু কুকি ও অন্যন্য উপজাতিদের জন্যে তা সমস্যারও সৃষ্টি করে। এই বিতর্কের মাঝে যে খবরটি হারিয়ে যায় তা হলো কুকিদের পাহাড়ি অঞ্চলগুলি খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ যা কর্পোরেট ক্ষেত্রের জন্য লোভনীয় লক্ষ। ফলে মেইতেইদের উপজাতির স্বীকৃতির ফল তাদের পরিচয়ের থেকেও সুদুরপ্রসারি।ঘটনাচক্রে ৪ঠা মে দুজন কুকি মহিলাকে রাস্তায় উলঙ্গ করে হাঁটানো এবং তাদের ওপর যৌন নির্যাতনের ভয়াবহ ভিডিও দুমাস পরে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ফ্রাঁন্সে সর্বোচ্চ সম্মান “গ্র্যান্ড ক্রস অফ দ্য লিজিয়ন অফ অনার” পাওয়ার পরে সর্বসমক্ষে এসেছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী মনিপুরের ঘটনাবলীকে সভ্য সমাজের জন্য ঘৃন্য কলঙ্ক বলে সঠিক ভাবেই অভিহিত করেছেন কিন্তু তার ফল কি হয়েছে? তাকি মনিপুরের একজন মানুষের জন্যেও সুখ বয়ে এনেছে?প্রশাসন নিরাময় স্পর্শের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। উল্টে কার্ফু, বন্ধ ইন্টারনেট, ব্যাপক সুরক্ষা বাহিনীর উপস্থিতি এবং দেখা মাত্র গুলির আদেশ হিংসায় ঘৃতাহুতির কাজ করেছে। রাজ্যের আফিম চাষিদের বিরুদ্ধে বিতর্কিত “ওয়ার অন ড্রাগ” বা মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রচার শুধু উত্তেজনা বৃদ্ধিরই কাজ করেছে এবং বেছে বেছে ব্যবস্থা নেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে যদিও মাদকের ব্যবসা, আফিমের বেআইনি চাষ ও ব্যবসার ক্ষেত্রগুলি সামাজিক ও ভৌগোলিক সীমারেখা ব্যাতিরেকেই বিদ্যমান রয়েছে।জাতিগত পরিচয় ব্যাতিরপকে হিংসা দমন করে মনিপুরের মানুষের জন্য সুরক্ষা নিয়ে নিশ্চিত করা রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব। কেন্দ্রে এবং রাজ্যে ডাবল ইঞ্জিনের সরকারের ব্যাপারে বিজেপির প্রচারের ঢক্কানিনাদ সত্বেও মনিপুরে দুটি ইঞ্জিনই লাইনচ্যুত হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের প্রশংসনীয় হস্তক্ষেপ সমস্যার গভীরতা এবং দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহনের প্রয়োজনীয়তার কথাই মনে করায়।মোদীজি, আপনার কাছে এখন একটিই আবেদন যে কি করলে আপনি আপনার মৌনতা ভঙ্গ করবেন। ভয়াবহ ভিডিও সর্বসমক্ষে আসার পর আপনি সংসদের বাইরে কয়েক মিনিট ব্যক্তব্য রেখেছেন এবং পশ্চিমবঙ্গ সমেত অন্যান্য রাজ্যকেও এরমধ্যে সংযুক্ত করেছেন। আমি নিজে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এবং সেঝানজার হিংসা নিয়ে নিয়ে আমি নিজে বারম্বার ব্যক্তব্য রেখেছি। তবু আমি আপনাকে বলছি দয়া করে আপনি মনিপুরে যান এবং নিজে দেখে অনুধাবন করুন সেখানকার হিংসাকে রাজনীতির নিরিখে দেখাটা কেন আপনার ভুল।অবশ্যই নিরবতা ক্ষেত্র বিশেষে প্রয়োজনীয় কিন্তু মনিপুর নিয়ে আপনার নিরবতা ফাঁপা এবং শুণ্যগর্ভ।

এটাকে শুধুমাত্র একজন বিরোধীর অগুনতি দাবির একটি বলে মনে করবেননা, এটি মনিপুরের মানুষ আপনার কাছে চায়। তারা আশা করে আপনি তাদের বলবেন যে আপনি তাদের পাশেই আছেন। আপনি শুধু বিজেপির নন, দেশের প্রধানমন্ত্রী। মনিপুরের মহিলা, পুরুষ এবং শিশুরা আপনার কাছে হিংসা নিয়ে রাজনৈতিক ব্যক্তব্য চায়না, তারা চায় তাদের প্রধানমন্ত্রী তাদের অন্ধকারতম সময়ে তাদের পাশে থাকবেন।

মনিপুরের মন ভগ্ন এবং আহত। মনিপুরের মন কি বাত হলো প্রধানমন্ত্রী তাদের কথা শুনবেন এবং বলবেন।আমরা, এই সংসদের সকলে একতাবদ্ধ ভারতকে চাই।

স্বাধীনতা দিবসের দুই হপ্তা আগে এটাই আমাদের অঙ্গীকার।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *