গত ২৩ ডিসেম্বর আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক সমীপেষু কলমে প্রকাশিত শান্তনু দত্ত চৌধুরীর চিঠি

সুভাষ নেহরু

‘প্রতিদ্বন্দ্বী নেহরু’ (সম্পাদক সমীপেষু, ১৮-১১) শীর্ষক পত্রে দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, কংগ্রেসের ত্রিপুরী অধিবেশনের প্রাক্কালে সুভাষ দলের সভাপতিত্বের জন্য গান্ধী সমর্থিত প্রার্থী পট্টভি সীতারামাইয়ার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এই মহারণে সুভাষ নেহরুর সমর্থন আশা করলেও তা পাননি। কিন্তু ওই নির্বাচন প্রসঙ্গে নেহরু যে গান্ধীজির সঙ্গেও দ্বিমত পোষণ করেছিলেন, তা লেখক উল্লেখ করেননি। ওই নির্বাচনে বল্লভভাই পটেল, রাজাগোপালাচারী, রাজেন্দ্রপ্রসাদ প্রমুখ তীব্র সুভাষ বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেন এবং নেহরু যে তা সমর্থন করেননি, সে প্রসঙ্গেও দীপঙ্করবাবু নীরব। ত্রিপুরীর প্রাক্কালে নির্বাচন সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য হল— সুভাষ ২১ জানুয়ারি, ১৯৩৯-এ একটি বিবৃতি দিয়ে বলেন, তিনি কংগ্রেস সভাপতি পদে প্রার্থী হচ্ছেন। এই নির্বাচনে তাঁর লড়াই ব্রিটিশ সরকার প্রস্তাবিত ‘ফেডারেশন’-এর (দেশীয় রাজন্যবর্গ শাসিত রাজ্যগুলির সঙ্গে একত্রে শাসনতন্ত্র গঠন) যাঁরা সমর্থক তাঁদের বিরুদ্ধে। গান্ধীজির সম্মতি নিয়ে পটেল ও কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির ছ’জন সদস্য ২৪ জানুয়ারি এক বিবৃতিতে সভাপতি পদে পট্টভি সীতারামাইয়াকে সমর্থন করেন। তাঁরা বিবৃতিতে এ কথাও জানান যে, ‘ফেডারেশন’ প্রশ্নে তাঁরাও ব্রিটিশের প্রস্তাবের বিরোধী ও সুভাষের সঙ্গে একমত। পটেল উপরোক্ত বিবৃতিতে সই করার জন্য অনুরোধ জানালে নেহরু আলমোড়া থেকে তারবার্তার মাধ্যমে জানান তাঁর পক্ষে এই যুক্ত বিবৃতিতে সই করা নীতিগত প্রশ্নে অসুবিধাজনক। পটেল নেহরুকে চিঠি দিয়ে জানান, তিনি এই বিবৃতিতে সই না করায় গান্ধীজি দুঃখ পেয়েছেন (নেহরু অ্যান্ড বোস: প্যারালাল লাইভস, রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায়)।

২৫ জানুয়ারি সুভাষ বিবৃতি দিয়ে বলেন, সীতারামাইয়ার প্রার্থী পদ ওয়ার্কিং কমিটি দ্বারা অনুমোদিত নয় এবং তিনি সর্বসম্মত প্রার্থীও নন। তাই পটেল ও অন্য সদস্যদের দু’জন সহকর্মীর মধ্যে এক পক্ষ অবলম্বন অনৈতিক। ২৬ জানুয়ারি নেহরু আলমোড়া থেকে বিবৃতিতে বলেন ফেডারেশন নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, অথচ অন্য কোনও নীতি, কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না। বহু প্রশ্নে বিতর্ক থাকলেও সর্বসম্মত ভাবেই কংগ্রেস ফেডারেশনের বিরুদ্ধে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির জন্য দেশ অচিরে সঙ্কটের মুখোমুখি হবে। এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেসকে আরও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তিনি মনে করেন বর্তমানে সুভাষ ও তিনি কংগ্রেস সভাপতি হলে তাঁদের কার্যকর ভূমিকা পালনের ক্ষমতা সঙ্কুচিত হবে।

মনে রাখতে হবে, ১৯৩৬ সালের মার্চে তিন বছর প্রবাসে কাটানোর পর সুভাষ দেশে ফেরামাত্র গ্রেফতার হন। তাঁর মুক্তির দাবিতে কংগ্রেস সভাপতি নেহরুর আহ্বানে ১০ মে দেশ জুড়ে ‘সুভাষ দিবস’ পালিত হয়। ১৯৩৭ সালের অক্টোবরে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সভায় নেহরু পরবর্তী সভাপতি পদে সুভাষের নাম প্রস্তাব করেন। পটেলের বিরোধিতা সত্ত্বেও গান্ধীজি তা সমর্থন করেন। ১৯৩৮-এর ফেব্রুয়ারিতে হরিপুরা কংগ্রেসে সুভাষ সর্বসম্মতিক্রমে দলের সভাপতি হন এবং নেহরুকে সভাপতি করে পরিকল্পনা কমিশন গঠন করেন। নেহরুর জীবনীকার ইতিহাসবিদ সর্বপল্লী গোপাল লিখেছেন ত্রিপুরী কংগ্রেস অধিবেশনে নেহরু নীরব ছিলেন। গোবিন্দবল্লভ পন্থ প্রস্তাব, যেটি রচনা করেন রাজাগোপালাচারী, তাতে বলা হয়েছিল, গান্ধীজির সঙ্গে আলোচনা করে তাঁর ইচ্ছানুযায়ী কংগ্রেস সভাপতি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করবেন। সুভাষ সমস্ত বামপন্থী গোষ্ঠীর সমর্থন পাননি। যখন শরৎ বসু পটেলকে বলেন কয়েকটি পরিবর্তন করলে তাঁর ও সুভাষের অনুগামীরা এই প্রস্তাব সমর্থন করতে পারেন, পটেল তাঁকে বলেন ‘একটি কমা, একটি শব্দও পরিবর্তন করা হবে না’ (নেহরু অ্যান্ড বোস: প্যারালাল লাইভস)।

সুভাষ এই সময় নেহরুকে এক দীর্ঘ চিঠিতে (২৮ মার্চ, ১৯৩৯) তাঁর বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ করেন। এই আক্রমণাত্মক চিঠির একটি শান্ত ও বিনয়ী উত্তর দেন নেহরু। চিঠিটি পেয়ে সুভাষ জামডোবা থেকে ১৫ এপ্রিল নেহরুকে লেখেন— “তোমার পক্ষে কি কয়েক ঘণ্টার জন্য এখানে আসা সম্ভব? তা হলে আমরা আলোচনা করতে পারি এবং পরবর্তী পদক্ষেপ করার ক্ষেত্রে তোমার পরামর্শ পেতে পারি।” উত্তরে নেহরু জানান “তোমাকে না বলার সাধ্য আমার নেই।” ১৯ এপ্রিল সকালে নেহরু জামডোবা আসেন, এবং হৃদ্যতার সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর ফিরে যান। ২০ এপ্রিল সুভাষ গান্ধীজিকে লেখেন “কাল জওহর এসেছিল… খুশি হলাম দেখে যে, আমাদের দু’জনের দৃষ্টিভঙ্গি মিলল।” ২৭ এপ্রিল গান্ধীজি সোদপুরের অভয় আশ্রমে আসেন। নেহরুও যোগ দিলেন কথাবার্তায়। ওয়ার্কিং কমিটির নাম প্রস্তাব করতে গান্ধীজি আবারও অরাজি হলেন। যখন বোঝা গেল কোনও বোঝাপড়ার দিকে এগোচ্ছে না কথাবার্তা, তখন কলকাতায় এআইসিসি-র বিশেষ অধিবেশনে সুভাষ পদত্যাগ করলেন। সেই পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করার জন্য এআইসিসি-র প্রতি আর্জি জানিয়ে প্রস্তাব আনলেন নেহরু। সুভাষকে পুরনো কমিটির সঙ্গে দু’টি শূন্য পদে তাঁর মনোনীত দু’জন সদস্যকে নিতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু সুভাষ রাজি হননি। অন্তর্বর্তী সভাপতি বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ যে ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করলেন, তাতে সুভাষ, নেহরু কেউই থাকেননি (দেশনায়ক সুভাষচন্দ্র ও ভারতের মুক্তি সংগ্রাম, সুগত বসু) গান্ধীজি ও ওয়ার্কিং কমিটির অন্য সদস্যদের অনমনীয় ভূমিকায় নেহরু খুবই বিরক্ত হন। এই ভাবে সুভাষকে দূরে সরিয়ে দেওয়া ছিল ভুল পদক্ষেপ। ৪ মে , ১৯৩৯ কৃষ্ণ মেননকে প্রদত্ত চিঠিতে নেহরু এই কথাগুলি লেখেন।

শান্তনু দত্ত চৌধুরী, কলকাতা-২৭

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *