শিক্ষায় গৈরিকীকরণ

সৈয়দ কওসর জামাল

স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, জাতীয়তাবাদী চরিত্র, ধর্মীয় বিভাজন, দেশভাগ সত্ত্বেও ভারত ও পাকিস্তান দুদেশেই সংখ্যালঘু মানুষের থেকে যাওয়া ইত্যাদি প্রেক্ষিত আমাদের সংবিধানরচয়িতাদের বিবেচনায় ছিল। তাই সংবিধান রচনার সময় এক উদার সহনশীল মানবিকতার দৃষ্টিভঙ্গি তাঁরা গ্রহণ করেছিলেন। প্রস্তাবনায় যে মহৎ লক্ষ্যের কথা ঘোষণা করা হয়েছে তার মধ্যে আছে ‘চিন্তা, চিন্তার প্রকাশ, ধর্মীয় বিশ্বাস ও ধর্মচর্চার স্বাধীনতা’। সংবিধানে যে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হয়েছে তার অর্থ শুধু ধর্মীয় কারণে নাগরিকদের মধ্যে প্রভেদ করা যাবে না তাই নয়, সব ধর্মের অধিকার সুরক্ষিত করার কথাও বলা হয়েছে।

‘শিক্ষার গৈরিকীকরণ’ হল দীর্ঘমেয়াদী এক এজেন্ডার অংশ যাতে সংবিধানের এই ঐতিহাসিক ভিত্তিকে দুর্বল করা যায় এবং তার গতিমুখকে উলটো দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়। আসলে, এই প্রচেষ্টার ফলে দেশকে এমন এক সামাজিক দ্বন্দ্বের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে, একদিন যার সমাধানের জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ আমাদের দেশনেতারা গ্রহণ করেছিলেন। বলা দরকার যে এজেন্ডা অতি পুরোনো। বিজেপির অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় মানবউন্নয়ন মন্ত্রী মুরলীমনোহর যোশী যেভাবে শিক্ষায় গৈরিকীকরণের পথে হেঁটেছিলেন, এখনকার বিজেপি সরকারও নতুন শিক্ষানীতি ও বিভিন্ন বিজেপি-শাসিত রাজ্যের শিক্ষায় সেই পথ ধরেই এজেন্ডা পূর্ণ করতে চাইছেন। স্পষ্টভাবে তাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে সন্দিহান। মুরলীমোহন যোশীর নির্দেশে এন-সি-ই-আর-টির তদানীন্তন নির্দেশক যে এস রাজপুত সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে জানিয়েছিলেন যে বিদ্যালয় কারিকুলাম গঠনের মধ্যে যে ভুল থেকে গেছে সেগুলোকে তাঁরা সংশোধন করতে চান। তাঁর মতে ভুলগুলো হল, ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির ওপর অত্যধিক জোর দিতে গিয়ে দেশের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যকে অবহেলা করা হয়েছে। মূল্যশিক্ষা বা ভ্যালু এডুকেশনকে তাঁরা গুরুত্ব দিতে চান। আর কে না জানে এই ভ্যালু এডুকেশন ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার অর্থই হল ধর্মীয় শিক্ষা অর্থাৎ হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থগুলো।। মূল্যবোধের শিক্ষা বা আধ্যাত্মিক শিক্ষার কথা গান্ধীজি ও সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানও বলেছেন। কিন্তু এঁদের সঙ্গে প্রভেদ হল, এঁরা আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য বলতে হিন্দু ঐতিহ্যকেই বুঝান। কিন্তু তা করতে গিয়ে তাঁরা যে সংবিধানের মূল চিন্তাকে অমান্য করতে চলেছেন তা তাঁরা মনে করেন না।

হিন্দু জাতীয়তাবাদী আবেগকে প্রশ্রয় দিতে নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি সরকারও দেশব্যাপী নীতি পরিবর্তনের পথে চলেছে। এর ফলে দলের উগ্র সমর্থক ও বিজেপির মূল চিন্তকগোষ্ঠী আর-এস-এসকে খুশি রাখা যায়। এ সবের উদ্দেশ্য ভারতীয় ঐতিহ্যের নামে হিন্দু ঐতিহ্য, ইসলামভীতি ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রসার। এই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে তাঁরা শিক্ষার বিষয়বস্তু বদলে দিতে চান। কারণ তাঁরা জানেন যে শিশু ও কিশোর মনে প্রথম থেকে যদি তাঁদের চিন্তাকে পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে দিয়ে গেঁথে দেওয়া যায়, তবে তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হবে। তাই পাঠ্যসূচির পরিবর্তন তাঁদের কাছে জরুরি এজেন্ডা হয়ে উঠেছে। জাত, লিঙ্গ ও ধর্মাচরণের পশ্চাতগামী মানসিকতা গঠনের সঙ্গে কর্তৃপক্ষ-মুখীন মনোভাব ও তীব্র মার্ক্সবাদবিরোধিতা তাঁদের লক্ষ্য। ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং (এনসিএআরটি) নির্মিত পাঠ্যবই খুব কার্যকরী হয়ে ওঠে যে কোনো এজেন্ডা প্রচারে, কারণ দেশের প্রায় ৯ হাজার কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে তাদের বই পড়ানো হয়। ফলে সিলেবাসের গৈরিকীকরণকে গুরুত্ব না দিয়ে আমাদের উপায় নেই। ২০০২ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে বাজপেয়ী সরকারের আমলে নির্মিত ইতিহাস বই সম্পর্কে ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে এই বইয়ে প্রচুর ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে, আর এই ভুলগুলো সংঘটিত হয়েছে ‘উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িক পক্ষপাত থেকে’।

কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের বাইরে আর এক ধরনের পাঠ্যবই পড়ানো হয় রাজ্য পরিচালিত বিদ্যালয়গুলোতে। এখানেই বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোর কথা আলাদা ভাবে আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। ধরা যাক রাজস্থানের কথা। রাজস্থানে পাঠ্যবই পুনর্লিখনের কাজ শুরু হয়েছে ২০১৬ সাল থেকে, বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর। প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যক্রমে প্রত্যেক শ্রেণিতে বৈদিক অঙ্ক শেখা আবশ্যিক এবং ইতিহাস বইয়ে থাকবে ‘ভারতীয় সংস্কৃতি’র পাঠ। এছাড়া পাঠ্য থাকবে বিজেপি সরকারের ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’ য় ‘বেটি বাঁচাও- বেটি পঢ়াও’ প্রকল্প। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ১৬৫ জনের একটি কমিটি, যাদের পাঠ্যক্রম তৈরিতে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না, নতুন পাঠ্যক্রম তৈরি করেছে। এই বইগুলোতে দেশের সংখ্যালঘু মানুষজন সম্পর্কে একটি বাক্যও খরচ করা হয়নি, শুধুই হিন্দু সংখ্যাধিক্যের গৌরবের কথা। বিজ্ঞান আলোচিত হয়েছে হিন্দ্য পুরাণকথার ভিতর দিয়ে। রদ করা সতীদাহ প্রথাকে গৌরব দান করা হয়েছে। দেশের সশস্ত্র সেনানীই প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধার ভাব জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। সংযোগের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির কথা বলতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদীর রেডিয়োবার্তা ‘মন কি বাত’ এর প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হয়েছে।

গুজরাটে সঙ্ঘের সহযোগী সংস্থা বিদ্যাভারতীর নেতা দীননাথ বাতরার লেখা বই পাঠ্যসূচিতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রাজ্যের প্রায় ৩৫ হাজার বিদ্যালয়ে তা পড়ানো হবে। ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ভাগবত গীতা পাঠের ব্যবস্থা করেছে গুজরাত সরকার। আর দীননাথ বাতরা কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী স্মৃতি ইরানির সঙ্গে দেখা করে সিবিএসসি-র পাঠ্যসূচি বদলের দাবি জানিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে জানানো দরকার যে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রক উপনিষদ ও বেদ পড়ানোর জন্য একটি কমিটি গঠন করেছেন। বিজ্ঞান, গণিত, দর্শনে হিন্দু প্রভাবকে খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। আর একটি এলাকায় বিজেপি পাঠ্যপুস্তক হিন্দুত্ব প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছে—তা হল কারা ভারতের বিপ্লবী। গুজরাট ও রাজস্থানে জোর দেওয়া হয়েছে ভগত সিং প্রমুখ বিপ্লবীদের ওপর। রাজস্থানে দশম শ্রেণির বইয়ে লেখা হয়েছে—“বিপ্লবী শহিদরা ভারতে স্বাধীনতার ইতিহাস লিখেছেন তাঁদের রক্ত দিয়ে।” জাতীয় কংগ্রেসের কথা নেই, নেই গান্ধিজির অহিংস স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রসঙ্গ। গান্ধীজি ও নেহরুর স্বাধীনতা আন্দোলনে ভূমিকাকে এভাবেই অস্বীকার করতে চায় আর-এস-এস। তাদের ইতিহাসে থাকেন বিনায়ক দামোদর সাভারকার। তাঁকে বলা হয়েছে’একজন মহান বিপ্লবী, মহান জাতীয়তাবাদী ও মহান সংগঠক’। অথচ সাভারকারের ভূমিকা সবাই জানেন কীভাবে ব্রিটিশদের প্রতি আনুগত্য দেখিয়েছিলেন তিনি। উত্তরাখণ্ডের বিজেপি সরকার শিক্ষানীতি বদলের কাজ শুরু করেছে। হিন্দী ভাষায় মেডিক্যাল শিক্ষাদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী ধ্যানসিং রাওয়াত রাজ্যের সব বিদ্যালয়ে গীতা রামায়ণ ও বেদ পড়ানো হবে বলে ঘোষণা করেছেন।

তাঁর মতে, ছোটো থেকে এই ধর্মগ্রন্থগুলো পড়ালে দেশের সংস্কৃতি শিশুরা আর কোনোদিন ভুলবে না। বিজেপি শাসিত আর একটি রাজ্য কর্নাটক কঠোরভাবে হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা অনুসরণ করে চলেছে। আর-এস-এস এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেডগাওয়ারের একটি বক্তৃতা পাঠ্যেএ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অথচ কেরলের শ্রী নারায়ণ গুরু কিংবা তামিলনাডুর পেরিয়ারের মতো সমাজসংস্কারকের কথা পাঠ্যে নেই। কর্নাটকে পাঠ্যবই রিভিউ কমিটির শীর্ষে আছেন সঙ্ঘ পরিবারের ঘনিষ্ট রোহিত চক্রতীর্থ। শিক্ষায় গৈরিকীকরণের লক্ষ্যেই কর্নাটক সরকার এইসব কাজ করছেই। শিক্ষায় এই গৈরিকীকরণের ফলে নতুন প্রজন্ম জানবে ভারতে মুসলিম শাসনের আগে যাকিছু গৌরবময় সব ঘটেছিল। ভারত নির্মাণে মোগল সম্রাটদের কোনো ভূমিকা ছিল না। মুসলিম শাসনকাল ছিলত্যাচার ও বর্বর নিষ্ঠুরতার কাহিনি। তারা প্রশ্ন করবে না ধর্মান্ধতা ও কুপ্রথাকে। উদারবাদী তথা মানবতাবাদী জীবনদর্শনের পরিচয় পয়াবে না তারা। গৈরিকীকরণ থেকে জন্মাবে ওন্ধ উন্মত্ততা, জাতি, গোষ্ঠী ও সাম্প্রদায়িক চেতনা। আর কণ্ঠ রোধ করবে যুক্তি ও বিচারধারার।

ঢাকঢোল পিটিয়ে নতুন কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতি ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। এই শিক্ষানীতি সম্পর্কে নানা মহল থেকে প্রতিবাদের ঝড় বইছে। তবু সংসদে সংখ্যাধিক্যের জোরে এই নীতি বাস্তবায়নের চেষ্টায় ত্রুটি রাখবে না মোদী সরকার। এই শিক্ষানীতিতে পঞ্চতন্ত্র, জাতক ও হিতোপদেশের কাহিনি বিদ্যালয়পাঠ্য করা হবে। চর্চা করা হবে পুরাণের ৬৪ কলার। ইংরেজিকে কম গুরুত্ব দিয়ে সংস্কৃত ভাষার প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। ডাক্তারি বিদ্যায় ঢুকবে আয়ুর্বেদ, নেচারোপ্যাথি, যোগ, ইউনানি। অনেক ব্যক্তির জীবনী পাঠের ব্যবস্থা করা হবে অথচ সেখানে থাকবেন না রামমোহন কিংবা বিদ্যাসাগর। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আর-এস-এস আগেই জানিয়েছে তাদের অসম্মতি। যেকোনো দিন তিনি পাঠ্যসূচি থেকে বাদ পড়বেন, এমন আশঙ্কা করাই যায়।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *