সন্দেশখালিতে তৃণমূল কংগ্রেসের অত্যাচার ও নোংরা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারবারি বিজেপি

অমিতাভ সিনহা

গত দেড়মাস ধরে সন্দেশখালি নিয়ে যা চলছে তা এক বিরলতম ঘটনা বললে ভুল বলা হবে না। নাটকের সূত্রপাত তৃণমূল দলের দুস্কৃতি নেতা শেখ শাহজাহানের বাড়ীতে ইডি হানা দেওয়ার দিন থেকে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল খাদ্য দপ্তরের পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির সঙ্গে তার যোগ।ইডি হানা দেওয়ার পর তার বাড়ীর দরজা খোলা হয় নি। অতএব বাড়ীর সামনে নোটিশ লটকে দিয়ে যখন তারা কেন্দ্রীয় বাহিনীর সাথে ফিরছিলেন ঠিক তখনই ওই দুষ্কৃতির সাগরেদ জেলা পরিষদের নির্বাচিত সদস্য শিবু হাজরা ও উত্তম সর্দারের নেতৃত্বে গুন্ডাবাহিনীর হিংসাত্মক আক্রমণে কয়েকজন ইডি অফিসার আহত হন।সঙ্গে থাকা কেন্দ্রীয় বাহিনীর জোওয়ানরা নিষ্ক্রিয় ছিল।এর পর থেকে শাহজাহান আত্মগোপন করে। তাকে আজও পুলিশ গ্রেপ্তার করেনি। এর পরই সাধারণ মানুষ মুখ খুলতে শুরু করেন। যার মধ্যে মহিলারাও আছেন। সেখানকার ভুক্তভোগী মহিলাদের জবানবন্দী ও উক্ত দুষ্কৃতিদের আহুত সভাকে কেন্দ্র করে যা ঘটেছে তা যে কোনও গণতান্ত্রিক ভাবধারায় বিশ্বাসী মানুষজনের মনে প্রশ্ন উদ্রেক করবেই । পুলিশ ও প্রসাশনের ভূমিকা দেখিয়ে দিয়েছে তারা আজ কত অসহায়। তাদের চোখের সামনে সততার প্রতীক শাসক দলের আশীর্বাদধন্য দুষ্কৃতিরা দিনের পর দিন একটা বিরাট এলাকাজুড়ে তাদের সাম্রাজ্য গড়ে তুলে সেখানকার মানুষকে ভীতসন্ত্রস্ত করে মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য করেছে, কিন্তু পুলিশের কিচ্ছুটি করার নেই। খাসজমি দখল, দুর্বল গ্রামবাসীর জমি ভয় দেখিয়ে নামামাত্র মূল্যে নিজেদের নামে লিখিয়ে নিয়ে মাছের ভেরি করা, ধান চাষের জমিতে নোনা জল ঢুকিয়ে তা অচাষযোগ্য করে নিজেদের নামে লিখিয়ে নিয়ে লিজের অর্থ থেকে দূর্বল গ্রামবাসীদের বঞ্ছিত করা থেকে আরম্ভ করে রাত্রে ভয় দেখিয়ে দলীয় অফিসে ঘরের মহিলাদের ডেকে ঘন্টার পর ঘন্টা তাদের দিয়ে ফাইফরমাশ খাটিয়ে তাদের মধ্যে সুশ্রী যুবতীদের দলীয় বা দুষ্কৃতি নেতাদের ব্যক্তিগত অপিসে মাঝরাত বা ভোর পর্যন্ত থাকতে বাধ্য করা সবই ঘটেছে সরকারি আধিকারিক ও পুলিশ প্রসাশনের জ্ঞাতসারে। কিন্তু তারা কোন সক্রিয়তা দেখান নি। ইডি অভিযানের পরেও দেখা গেল তারাই আবার এই নেতাদের আড়াল করছে। এই আচরণ কি মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর অজ্ঞাতসারে ঘটেছে? তাই যদি হয় তাহলে বলতে হয় পুলিশ প্রসাশনের ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে গেছে। অন্যথায় তিনিও এই অন্যায় কর্মের দায়িত্ব এড়াতে পারেন না।

    আসলে শাসকদলের জার্সি গায়ে থাকলে তার সবধরনের কুকাজ করার অধিকার জন্মে যায় তা অনুব্রত মন্ডল থেকে আরাবুল ইসলামকে দেখলেই বোঝা যায়। তবে এটা যে বামআমল থেকেই শুরু হয়েছে তা অস্বীকার করার কিছু  নেই। মুখ্যমন্ত্রী যতই শাহজাহানকে রক্ষা করা বা সাজানো ঘটনা বলে লঘু করার চেষ্টা করুক না কেন, এই অপরাধের দায়  তাঁকেও নিতে হবে। এতকিছুর পরেও কেন শেখ শাহজাহানকে পুলিশ ধরতে পারল না ?
এটাও দেখা গেল ঘটনার পর শিবু উত্তম বাহিনী এলাকায় সভা করে গ্রামবাসীদের ওপর হুমকি দিলে বাড়ীর মহিলারা যেভাবে ঝাঁটা লাঠি হাতে তাদের ওপর চড়াও হয়ে নদী পার হয়ে পালাতে বাধ্য করে, তাতে এই সর্বশক্তিমানদের ওপর গ্রামবাসীদের ক্ষোভের পরিমান আন্দাজ করা কঠিন নয়। এরপর তিন মন্ত্রীর উপস্থিতিতে তৃণমূলী দুস্কৃতিদের অপরাধ স্বীকার করে টাকা ফেরতের মেলা হল তাতে প্রমাণ হয়ে গেল গ্রামবাসীদের অভিযোগের সত্যতা। আরো ভালভাবে এতে শিলমোহর পড়ল যখন এই দুই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে গ্রেপ্তার করা হল। পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে গণধর্ষনের ও খুনের চেষ্টার ধারা দেয়। এর বেশ কিছু পুরানো অভিযোগ বা মামলা। তাহলে এতদিন পুলিশ কি করছিল? এমনকি পুলিশও দাবী করেছে একজন মহিলার গোপন জবানবন্দী দিয়েছেন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে।  আবার স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী সিউড়িতে বলেছেন যে নাকি এখনও পর্যন্ত কোন মহিলা অভিযোগ জানান নি। তাহলে কার কথা ঠিক এই ধন্দ রয়ে গেল।

সন্দেশখালীর ঘটনা অতীব নিন্দনীয়,সমস্ত রাজনৈতিক দল এর নিন্দায় মুখর। তাদের সন্দেশখালি যেতে বাধা দেওয়া হয়েছে বারংবার। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীকেও মাঝরাস্তায় আটকে দেওয়া হয়েছে। তিনি বাধ্য হলেন রাস্তায় দীর্ঘক্ষন বসে প্রতিবাদ জানাতে।
কিন্তু এরই মধ্যে বিজেপি যেভাবে এই ঘটনাকে নিয়ে মেরুকরণের খেলায় নেমেছে তা রাজ্যের পক্ষে অতীব বিপজ্জনক। তারা বলছে এ হল হিন্দু মহিলাদের ওপর মুসলীমদের আক্রমণ। তাহলে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয় শিবু হাজরা বা উত্তম সর্দার মুসলীম নাকি? কেন্দ্রীয়মন্ত্রী স্মৃতি ইরানী একধাপ এগিয়ে তার উর্বর মস্তিষ্কের প্রমাণ দিয়ে মন্তব্য করেছেন শিবু হাজরা নাকি জন্মগতভাবে মুসলীম, হিন্দু নাম নিয়ে ধোঁকা দিচ্ছে।আবার যে প্রধানমন্ত্রী চারশ আসন পাওয়া নিশ্চিত হওয়ার বার্তা দিচ্ছেন তিনি আসছেন এবিষয়ে সভা করতে। যিনি বিগত ১০ মাস ধরে জ্বলন্ত মনিপুরে গিয়ে সভা করতে চান নি। চেয়েছেন ওই গন্ডগোল চলতে থাকুক। ধর্মীয় বিভাজন হোক মানুষের মধ্যে। ব্যর্থ হয়েছেন ওই রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে।। এই সর্বনাশা চেষ্টার বিরুদ্ধে আমাদের সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করা জরুরি।
রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা তো প্রতিদিন তার দলের সভাপতির সঙ্গে লড়াইয়ে ব্যস্ত। কুকথায় তার জুড়ি মেলা ভার। টিভি চ্যানেলে তাকে তোয়ালে মুড়ে ঘুষ নিতে দেখেছিলেন দেশবাসী। তিনি সর্বদা যে অপরকে চোর বলেন তাই না,বিনা প্ররোচনায় রাহুল গান্ধী, যিনি নিজের মত করে সারা ভারতে পায়ে হেঁটে বা বাসে চড়ে বিভেদের রাজনীতির বিরুদ্ধে জনমত গঠনে ব্যস্ত তার সম্পর্কেও কুকথা বলতে ছাড়েন নি। তিনিই আবার এক শিখ পুলিশ আধিকারিককে খালিস্থানি হিসাবে দাগিয়ে দিলেন। সিপিএম নেত্রী বৃন্দা দিদিকে ( কারাত ) বলে বসলেন এই শাহজাহান নাকি তাঁদের সৃষ্টি। শুভেন্দু অধিকারী কি ভুলে গেছেন যে তিনি তিন চার বছর আগেও তৃণমূল কংগ্রেস করতেন ? ২০১৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় তিনিই তো ফরমান দিয়েছিলেন যে গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচনে গ্রামকে বিরোধীশূণ্য করতে পারলে পাঁচ কোটি করে টাকা দেওয়া হবে।
জাতীয় মহিলা কমিশন সন্দেশখালি এলেন। তার সভানেত্রী রেখা শর্মা নিদান দিলেন যে আইন শৃঙ্খলা এতই বিপন্ন যে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জরুরি। তার কি এ মন্তব্য করার আদৌ এক্তিয়ার আছে? মণিপুরে যখন মাসের পর মাস আগুন জ্বলে, ৭০ হাজার ত্রাণ শিবির খুলতে হয়,নারীদের উলঙ্গ করে প্রকাশ্যে রাস্তায় হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, মেইতেইরা কুকিদের বা কুকিরা মেইতেইদের এলাকায় ঢুকতে পারে না তখন রেখা শর্মারা
মণিপুরে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না। আবার বিজেপির বিশেষ জাতীয় কর্মসমিতির সভায় বলা হয়েছে স্বাধীনতা উত্তর ভারতে নাকি এত নক্কারজনক ঘটনা আর ঘটে নি।আমরা কি ভুলে গেছি মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকাণ্ড ? গুজরাট দাঙ্গা, হাথরস, উন্নাও এর নারী নির্য়াতন বা বিলকিস বানোর ঘটনা? আন্তর্জাতিক পদকজয়ী মহিলা কুস্তিগিরদের ওপর যখন অত্যাচার হল তখন কোথায় ছিল মহিলা কমিশন বা তার চেয়ারপার্সন রীতা শর্মা?
কপট ভালোবাসা দেখানোর জন্য মোদীজি বারাসত আসছেন। সন্দেশখালির অত্যাচারিত মানুষ ও মা বোনদের প্রতি সহানুভূতির জন্য নয়, তিনি আসছেন ভোটের জন্য। তিনি মণিপুরে যান, ওখানকার অপদার্থ মুখ্যমন্ত্রীকে সরান ও রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে দেখান। তারপর না হয় সন্দেশখালি নিয়ে কথা বলবেন।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *