কংগ্রেস সংসদীয় দলের চেয়ারপারসন শ্রীমতী সোনিয়া গান্ধীর লেখা ‘দ্য হিন্দু’-তে প্রকাশিত প্রতিবেদন :

(অনুলিখন : সৌরভ কুন্ডু)

একটি বলপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া নীরবতা ভারতের সমস্যার সমাধান করতে পারে না।

গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতার প্রতি সরকারের গভীর অবজ্ঞা অত্যন্ত বিরক্তিকর।

ভারতের জনগণ শিখেছেন যে আজকের পরিস্থিতি বোঝার ক্ষেত্রে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কর্মকাণ্ড, তাঁর কথার চেয়ে অনেক বেশি জোরে উচ্চারিত। তাঁর বক্তব্যসমূহ – যখন তিনি বিরোধীদের উপর ক্ষোভ প্রকাশ করছেন না বা আজকের অস্থিরতার জন্য অতীতের নেতাদের দোষারোপ করছেন না, – তখন হয় তিনি দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিকে উপেক্ষা করছেন, অথবা এই বিষয়গুলি থেকে আলোকপাত করা বা বিভ্রান্ত করার জন্য অদ্ভুত মৌখিক নমনীয়তা অথবা মৌখিক বাগাড়ম্বরের আশ্রয় নিচ্ছেন। অন্যদিকে, তার ক্রিয়াকলাপ কিন্তু সরকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে কল্পনার জন্য সামান্যই জায়গা ছেড়ে দেয়।

প্রতিষ্ঠানগুলির ওপর হামলা :

বিগত কয়েক মাস ধরে, আমরা প্রত্যক্ষ করেছি প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর সরকারের ক্রিয়াকলাপ পদ্ধতিগতভাবে ভারতের গণতন্ত্রের তিনটি স্তম্ভ – আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগ – এর ক্ষেত্রে, গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতার প্রতি গভীর অবজ্ঞা প্রদর্শন করে। প্রথমে আপনারা সংসদে ঘটিত সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো বিবেচনা করুন। গত অধিবেশনে, আমরা প্রত্যক্ষ করেছি কিভাবে সরকারি নেতৃত্বে, কৌশলে সংসদকে বিঘ্নিত করার এবং বিরোধী দলগুলিকে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির সাথে বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি এবং সামাজিক বিভাজনের মতো গুরুতর উদ্বেগের বিষয়গুলি উত্থাপন করার এবং বর্তমান আর্থিক বছরের বাজেট এবং আদানি কেলেঙ্কারি নিয়ে আলোচনা করা থেকে প্রতিরোধ করার প্রয়াস। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বিরোধীদের মুখোমুখি হতে না পেরে, অবশেষে নরেন্দ্র মোদি সরকার নজিরবিহীন পদক্ষেপের আশ্রয় নেয় – বক্তৃতা মুছে ফেলা, আলোচনা রোধ করা, সংসদ সদস্যদের আক্রমণ করা এবং অবশেষে, বিদ্যুৎ গতিতে একজন কংগ্রেস সাংসদকে অযোগ্য ঘোষণা করা। ফলে জনগণের অর্থের ৪৫ লাখ কোটি টাকার বাজেট কোনো বিতর্ক ছাড়াই সংসদে পাস হয়ে গেল। প্রকৃতপক্ষে, যখন লোকসভার মাধ্যমে অর্থ বিল পাস হয় তখন প্রধানমন্ত্রী বিস্তৃত মিডিয়া কভারেজের সাথে তার নির্বাচনী এলাকায় প্রকল্পগুলির উদ্বোধনে ব্যস্ত ছিলেন।

নরেন্দ্র মোদী সরকারের সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (CBI) এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ED) অপব্যবহার সুপরিচিত, ৯৫% – এরও বেশি রাজনৈতিক মামলা শুধুমাত্র বিরোধী দলগুলির বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছে – অথচ যারা ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) তে যোগদান করে তাদের বিরুদ্ধে মামলাগুলি অলৌকিকভাবে বাষ্পীভূত হয়ে যায় ৷ সাংবাদিক, সক্রিয় সমাজকর্মী এবং স্বনামধন্য চিন্তাবিদ-দের বিরুদ্ধে জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত আইনের অপব্যবহার নজিরবিহীন। প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচিত ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে আর্থিক জালিয়াতির অভিযোগ উপেক্ষা করা, ইন্টারপোল কর্তৃক পলাতক মেহুল চোকসির বিরুদ্ধে নোটিশ প্রত্যাহার করা এবং বিলকিস বানোর দোষী সাব্যস্ত ধর্ষকদের মুক্ত করা এবং বিচারপ্রার্থীকে অব্যাহতি দেওয় – এতদসত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী সত্য ও ন্যায়বিচার সম্পর্কে সর্বদাই মহৎ বিবৃতি দেন এবং সেইসব অভিযুক্ত বিজেপি নেতাদের সঙ্গে মঞ্চ ভাগাভাগি করেন।

বিচার বিভাগের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন করার পদ্ধতিগত প্রচেষ্টা কতটা সংকটজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় যখন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কিছু অবসরপ্রাপ্ত বিচারককে “দেশবিরোধী” বলে অভিহিত করেন এবং সতর্ক করেন যে “তাদের মূল্য চোকাতে হবে” বলে। এই ভাষাটি ইচ্ছাকৃতভাবে লোকেদের বিপথগামী করার জন্য, তাদের আবেগকে প্রজ্বলিত করার জন্য এবং বিচারকদেরকে ভয় দেখানোর জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে।

আক্রমণ এবং ভয় দেখানো :

মিডিয়ার স্বাধীনতা দীর্ঘদিন ধরে সরকারের রাজনৈতিক ভীতিপ্রদর্শন এবং বিজেপির বন্ধুদের আর্থিক শক্তির দ্বারা আপস করা হয়েছে, আর সংবাদ চ্যানেলগুলিতে সন্ধ্যায়, বিতর্ক সভা গুলিতে যারা সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, তাদের চিৎকারের মাধ্যমে নীরব করার জন্য অপবাদমূলক এক একটি অনুষ্ঠানে পর্যবসিত হয়েছে। এতেও সন্তুষ্ট না হয়ে, সরকার “ভুয়া তথ্য বা ফেক নিউজ” লেবেলে, অপছন্দ করে, এমন কোনো সংবাদের আইনি সুরক্ষা অপসারণের জন্য তথ্য প্রযুক্তি বিধি সংশোধন করে আইনী ক্ষমতা বলে নিজেদের সুরক্ষিত করেছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি স্পষ্ট করে বলেছে যে সরকারের সমালোচনা করলেই কোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপ করা যাবে না। সরকার কি আদৌ তা’ শুনছেন? এতে কোনো দ্বিমত নেই যে বিজেপি এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) কর্তৃক নিযুক্ত আইনজীবীদের একটি বিশাল বাহিনী কখনো তাদের মহান নেতার সমালোচনা প্রকাশ করলেই যেকোনো প্ল্যাটফর্মকেই হয়রানি করতে সর্বদা প্রস্তুত।

নীরবতা পালন করলেই কিন্তু ভারতের সমস্যার সমাধান হবে না। প্রধানমন্ত্রী, তার সরকারের কর্মকাণ্ডের সম্পর্কে সেই সমস্ত বৈধ প্রশ্নে নীরব রয়েছেন যা লক্ষাধিক মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে। অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বেকারত্ব বা মুদ্রাস্ফীতির কথা উল্লেখ করেননি—এমন দৃষ্টিভঙ্গি যেন এসব সমস্যাগুলি নেই। তার এই নীরবতা দুধ, শাকসবজি, ডিম, রান্নার গ্যাস এবং তেলের মতো দৈনন্দিন পণ্যের যোগানের সামর্থ্যের জন্য সংগ্রামরত কোটি কোটি মানুষকে বা রেকর্ড বেকারত্ব হার সম্মুখীন করা যুবসমাজ কাউকেই মোটেই সাহায্য করে না। ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতিতে ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী আশ্চর্যজনক ভাবে নীরব রয়েছেন। কিন্তু কৃষি ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান খরচ এবং ফসলের জন্য প্রাপ্ত পর্যাপ্ত দামের সমস্যাগুলি এখনও যথারীতি রয়েই গেছে।

প্রধানমন্ত্রী ঘৃণা ও সহিংসতার ক্রমবর্ধমান জোয়ারকে ক্রমাগত উপেক্ষা করেছেন যা দেশে বিজেপি এবং আরএসএস নেতাদের দ্বারা প্ররোচিত করা হয়েছে এবং তিনি একবারও শান্তি বা সম্প্রীতির আহ্বান জানাননি, বা অপরাধীদের গ্রেপ্তার করার দায়িত্ব নেন নি বা এমন কোন প্রচেষ্টা দেখা যায় নি যাতে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা যায়। ধর্মীয় উৎসবগুলি যেন অন্যদের ভয় দেখানোর উপলক্ষ হয়ে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে — সেগুলি এখন আনন্দ উদযাপনের উপলক্ষ থেকে অনেক দূরে ৷ পরিবর্তে, শুধুমাত্র ধর্ম, খাদ্য, বর্ণ, লিঙ্গ বা ভাষাগত বিভাজন সৃষ্টি করে ভীতি ও বৈষম্যর পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে।

চীনের সাথে সীমান্ত সংক্রান্ত বিষয়ে বা চীনের অনুপ্রবেশের বিষয়ে একদিকে যেমন প্রধানমন্ত্রীর চমকপ্রদ অস্বীকৃতি, সংসদে এই ব্যাপারে আলোচনাকে অবরুদ্ধ করা, অন্যদিকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী চীনের সঙ্গে মুখোমুখি সমরে আগে ভাগেই পরাজিত মনোভাব গ্রহণ করেছেন, যাতে করে তারা অন্তর্নিহিত অর্থে আরো সাহসী হয়েছে।

সামনের দিনগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ :

প্রধানমন্ত্রীর সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, ভারতের জনগণ কিন্তু নীরব হতে পারে না এবং হবেও না। আগামী কয়েকটি মাস আমাদের গণতন্ত্রের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে নির্বাচন করার জন্য প্রস্তুত, ওদিকে আমাদের দেশবাসীও যেন চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। কংগ্রেস পার্টি তাঁর বার্তা সরাসরি জনগণের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করবে, যেমনটি আমরা ভারত জোড়ো যাত্রায় করেছিলাম, এবং ভারতের সংবিধান এবং তার আদর্শ রক্ষার জন্য সমস্ত সমমনস্ক দলগুলির সাথে হাত মিলিয়ে একসাথে চলবে।

আমাদের লড়াই জনগণের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করা থেকে রক্ষার লড়াই। কংগ্রেস দল দেশের প্রধান বিরোধী দল হিসাবে তাঁর একান্ত কর্ত৭ব্য অবশ্যই বোঝে এবং তা কার্যকরী করার জন্য সমস্ত সমমনস্ক দলগুলির সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে সর্বদা প্রস্তুত।

———————কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ ‘ The Hindu’

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *