শান্তনু দত্ত চৌধুরী
এই দেশকে একটি ধর্মান্ধ হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করবার লক্ষ্য নিয়ে ১৯২৫ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে ভারতীয় জাতিসত্তা গড়ে উঠছিল তা থেকে আর.এস.এস ও হিন্দু মহাসভা সযত্নে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে ।এরা কোনদিন স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেয়নি।এরা সর্বদাই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করত।এদের তাত্ত্বিক প্রেরণাদাতা সাভারকর প্রথম জীবনে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিলেও ১৯২১ সালে মুচলেকা দিয়ে আন্দামান সেলুলার জেল থেকে মুক্তি পান।আর কোনও দিন তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেননি।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁর হিন্দু মহাসভা ও আর.এস.এস এর কাজ ছিল ব্রিটিশ সেনা বাহিনীতে হিন্দু যুবকদের রিক্রুট করা। তিনি মহাত্মা গান্ধির হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন বলে জোরালো প্রমাণ আছে।বেনিফিট ওফ ডাউট – এ লোয়ার কোর্ট তাকে মুক্তি দিলেও জে.এল.কাপুর কমিশন তাদের রিপোর্ট – এ পরিস্কার ভাবে সাভারকরকে দোষী সাব্যস্ত করে।ততদিনে সাভারকর প্রয়াত হয়েছেন।
বিনায়ক দামোদর সাভারকর ১৯২৩ সালে তাঁর বিখ্যাত ‘ হিন্দুত্ব ‘ পুস্তক রচনা করে প্রথম ‘ দ্বিজাতিতত্ত্ব ‘ প্রচার করেন।মুসলিম লিগ ও মহম্মদ আলী জিন্না ১৯৪০ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান দাবি করার ১৭ বছর আগে সাভারকর ওই বিভাজনের তত্ত্বের জন্ম দেন।তাঁর মতে হিন্দু ও মুসলমানরা দুটি পৃথক জাতি।তারা কখনো পাশাপাশি বাস করতে পারবেনা। দাঙ্গা হাঙ্গামা সৃষ্টি করে ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে বিভক্ত করে এই দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের শাসন প্রতিষ্ঠা করাই এই হিন্দুত্ববাদী শক্তির লক্ষ্য।
তবে আর.এস.এস – এর প্রতিষ্ঠাতা ডা. কেশবরাও হেডগেওয়াড় থেকে দ্বিতীয় সরসংঘ — চালক মাধব সদাশিবরাও গোলওয়ালকর হয়ে বর্তমান মোহন ভাগবৎ পর্যন্ত সকলেই হিন্দুত্বের শুদ্ধতা রক্ষার জন্য ব্রাম্ভন্যবাদি সুপ্রিম্যাসির কথা বলে গিয়েছেন/ বলেন।গোলওয়ালকর তাঁর বিখ্যাত ‘ We and our Nation defined ‘ গ্রন্থে লিখেছেন যে এদেশে বাস করতে হলে মুসলমান ও খ্রিস্টানদের হিন্দুদের বশ্যতা মেনে চলতে হবে ও দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে বাস করতে হবে।আর গোলওয়ালকর তাঁর অপর গ্রন্থ ‘ Bunch of thoughts ‘ গ্রন্থে লিখেছেন ভারতে জাতি সমস্যা সমাধানের জন্য জার্মানির চ্যান্সেলর এড়লফ হিটলারের পথ অনুসরণযোগ্য। অর্থাৎ ইহুদি নিধন। মহিলাদের সম্পর্কেও সংঘ পরিচালকদের দৃষ্টিভঙ্গি মধ্যযুগীয়।তারা মনে করেন সন্তান উৎপাদন করাই তাদের প্রধান কর্তব্য। আসন্ন পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের প্রাক্কালে আর.এস.এস – এর অনুগামী বিজেপি সরকারি চাকরিতে মহিলাদের জন্য ৩৩% সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।কিন্তু কোনো বিজেপি শাসিত রাজ্যে এই সংরক্ষণ নেই। আর স্বয়ং গোলওয়ালকর মহিলাদের চাকরিতে সংরক্ষণ সম্পর্কে বলেছিলেন এই ব্যবস্থা আর একটি Ism (মতবাদ) এর জন্ম দেবে, আর তা হচ্ছে Sexism ( যৌনতা )।
বিজেপি ও সংঘ পরিবারের উপরোক্ত কর্মসূচি রূপায়ণের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধক ভারতীয় সংবিধান ও ভারতীয় জনসাধারণের ঐক্য।আমাদের সংবিধান ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ফলশ্রুতি।এই সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে এই হিন্দুত্ববাদীরা বাঁধা দিয়েও তা প্রতিহত করতে পারেনি।এখন সংবিধান প্রদত্ত গণতন্ত্রকে ব্যাবহার করে তারা ক্ষমতায় পৌঁছে গিয়ে ভিতর থেকে অন্তর্ঘাত করে সংবিধানকে ধ্বংস করার ব্যাবস্থা করছে। গণতন্ত্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান আজ বিপর্যস্ত। দেশ জুড়ে মহিলা, দলিত ,আদিবাসী , সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত।
পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন বিধানসভার নির্বাচনকে সামনে রেখে বিজেপি ও সংঘ পরিবার সাম্প্রদায়িক বিভাজন ঘটানোর জন্য যে নিকৃষ্ট মানের রুচিহীন সাম্প্রদায়িক প্রচার চালাচ্ছে তা এককথায় অভূতপূর্ব।নির্বাচন কমিশন নীরব দর্শক।
শুধু তাই নয় হিটলার ও মুসোলিনির পররাষ্ট্রনীতির মূল উপাদান ছিল প্রতিবেশী দেশকে আতঙ্কে রাখো ,দোষারোপ করে গণ্ডগোল পাকাও , যুদ্ধ বাধাও, দেশের মধ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদী পরিবেশ তৈরি কর।ওই বৈদেশিক নীতির ভিত্তিতে বন্ধু দেশ বাংলাদেশ সম্পর্কে দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করে অমিত শাহ তীব্র প্রতিবাদের সম্মুখীন হয়েছেন। অনুপ্রবেশ নিয়ে এই রাজ্য নির্বাচনের সামনে এখানে বাজার গরম করছেন কেন অমিত শাহ? কেন মোদি বাংলাদেশে গিয়ে এই বিষয় নিয়ে একটা কথাও বলেন নি? অযোগ্য শাসন ও অপদার্থ পরিচালনার ফলে বাংলাদেশের থেকে ভারতকে একটি পশ্চাদপদ দেশে পরিণত করে এখন এই রাজ্যে সাম্প্রদায়িক কার্ড খেলছেন। সাহস থাকলে মোদি অমিত শাহ আমাদের জলসীমানার মধ্যে বুকে আমেরিকা যে নৌ মহড়া দিচ্ছে তার প্রতিবাদ করুন। চিনের হাত থেকে লাদাখের জমি পুনরুদ্ধার করুন। বাংলাদেশ নিয়ে বিদ্বেষমূলক কথা বললে কিছু অন্ধ ভক্ত বাহবা দিতে পারে, সকলে বুদ্ধি বিবেচনা বিসর্জন দেয়নি।