ভারতীয় নবজাগরণের অন্যতম প্রধান পুরোহিত ————————–

পন্ডিত ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।পিতা –ঠাকুরদাস বন্দোপাধ্যায় ও মা- ভগবতী দেবী।

বাংলা তথা ভারতের নবজাগরণের তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান পুরোহিত। পুরাতন জীর্ণ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন।

প্রখর পান্ডিত্য ও পর্বত সদৃশ ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই মনীষী শানিত যুক্তি সহকারে রক্ষণশীলতার দুর্গে আঘাত করেছিলেন।তাঁর জন্মবার্ষিকীতে তাঁর পবিত্র স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।

পুরুষশাসিত সমাজে সেইযুগে নারিজাতির প্রতি বঞ্চনা ও নিপীড়নের অবসানের জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। বাল্যবিধবাদের দুঃখ মোচনের জন্য তিনি বিধবা বিবাহর পক্ষে সরকারকে দিয়ে ১৮৫৬ সালে আইন প্রণয়ন করান।তাঁর ছাত্র শ্রীশ চন্দ্র বিদ্যারত্ন প্ৰথম বিধবা বিবাহ করেন।পাত্রী ছিলেন যশোরের কালিমতি নাম্নী বাল্য বিধবা।

১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ হয়।ব্রিটিশশাসকদের ধারণা হল ‘ হিন্দু বিধবাদের বিবাহেরআইন’ প্রবর্তিত হওয়ায় রক্ষণশীল হিন্দু সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে এবং তারই ফলশ্রুতি সিপাহি বিদ্রোহ।এ বিষয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মেজর জেনারেল এইচ.টি.টাকার- এর রিপোর্ট প্রণিধানযোগ্য।

এইবার ব্রিটিশ শাসকরা বেঁকে বসল । বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অক্লান্ত চেষ্টা সত্ত্বেও তারা রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের বাধাদান মেনে নিল। ‘বাল্য বিবাহ ও বহু বিবাহ ‘ রোধে তারা কোনও আইন করতে রাজি হলনা। বিদ্যাসাগর মহাশয় যা চেয়েছিলেন অর্থাৎ বাল্য বিবাহ ও বহু বিবাহ নিষিদ্ধকরণ কার্যকর হয় ১০০ বছর পর, যখন স্বাধীন ভারতে পন্ডিত নেহরুর সরকার ১৯৫৫ সালে বহু বিবাহ ও বাল্য বিবাহ নিষিদ্ধকরণের জন্য ‘হিন্দু কোড বিল’ পাস করে, এই বিলটির রচনাকার ছিলেন পূর্বতন আইনমন্ত্রী ড.বি.আর.আম্বেদকর।বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সময়ের মতন স্বাধীন ভারতেও রক্ষণশীল হিন্দুত্ববাদী দল/সংগঠন ও নারী স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি এই হিন্দু কোড বিলের চরম বিরোধিতা করে।

১৮৭০ সালে তাঁর একমাত্র ছেলে নারায়ণচন্দ্র বিধবা বিবাহ করার সিদ্ধান্ত নিলে তিনি তাঁকে সমর্থন করেন। তাঁর ছোট ভাই শম্ভুচন্দ্র ঈশ্বরচন্দ্রকে বলেন, এই বিবাহ হলে আত্মীয়স্বজন ও গ্রামবাসীরা তাঁদের পরিত্যাগ করিবে। তিনি তার পরিপ্রেক্ষিতে শম্ভুচন্দ্রকে লেখেন “…..নারায়ণ স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া এই বিবাহ করিয়া, আমার মুখ উজ্জ্বল করিয়াছে এবং লোকের নিকট আমার পুত্র বলিয়া পরিচয় দিতে পারিবে, তাহার পথ করিয়াছে। বিধবা বিবাহ প্রবর্তন আমার জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম । এ জন্মে যে ইহা অপেক্ষা অধিকতর আর কোনো সৎকর্ম করিতে পারিব, তাহার সম্ভাবনা নাই। এ বিষয়ের জন্য সর্বস্বান্ত হইয়াছি এবং আবশ্যক হইলে প্রাণান্ত স্বীকারেও পরাম্মুখ নহি। সে বিবেচনায় কুটুম্ববিচ্ছেদ অতি সামান্য কথা। কুটুম্বমহাশয়ের আহার-ব্যবহার ত্যাগ করিবেন, এই ভয়ে যদি আমি পুত্রকে তাহার অভিপ্রেত বিধবাবিবাহ হইতে বিরত করিতাম, তাহা হইলে আমা অপেক্ষা নরাধম আর কেহ হইত না।

…..আমি দেশাচারের নিতান্ত দাস নহি; নিজের বা সমাজের মঙ্গলের নিমিত্ত যাহা উচিৎ বা আবশ্যক বোধ হইবে তাহা করিব; লোকের বা কুটুম্বের ভয়ে কদাচ সংকুচিত হইব না’। ….অনমনীয় দৃঢ়তা ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

মাইকেল মধুসূদন তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন, ‘The genious and wisdom of an ancient sage, the energy of an Englishman and the heart of a Bengal mother.’কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘চারিত্র পূজা’ শীর্ষক প্রবন্ধ সংকলনে এই মনীষী সম্পর্কে লিখেছেন ‘বিদ্যাসাগর এই বঙ্গদেশে একক ছিলেন।

এখানে যেন তাঁহার স্বজাতি সোদর কেহ ছিল না। এ দেশে তিনি তাঁহার সমযোগ্য সহযোগীর অভাবে আমৃত্যুকাল নির্বাসন ভোগ করিয়া গিয়াছেন। তিনি সুখী ছিলেন না। তিনি নিজের মধ্যে যে এক অকৃত্রিম মনুষ্যত্ব সর্বদাই অনুভব করিতেন, চারিদিকে জনমণ্ডলীর মধ্যে তাহার আসন দেখিতে পান নাই। তিনি উপকার করিয়া কৃতঘ্নতা পাইয়াছেন, কার্যকালে সহায়তা প্রাপ্ত হন নাই। তিনি প্রতিদিন দেখিয়াছেন আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না, আড়ম্বর করি, কাজ করি না, যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না, যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না, ভুরি পরিমান বাক্য রচনা করিতে পারি, তিল পরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না, আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতা লাভের চেষ্টা করি না, আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি, পরের অনুকরণ আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহ আমাদের সম্মান, ওপরের চক্ষে ধূলি নিক্ষেপ আমাদের পলিটিক্স….এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন,দাম্ভিক, তার্কিক জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিক্কার ছিল।’

. — বিনয়াবনত

শান্তনু দত্ত চৌধুরী

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *