মেঘনাদ সাহা : বিরল বিজ্ঞান প্রতিভার সঙ্গে স্মরণীয় তাঁর সামাজিক ও রাজনৈতিক অবদান

Meghnad Saha (6 October 1893 – 16 February 1956) : A Village Boy Became One of India’s Greatest Scientists.Meghnad Saha’s thermal ionisation theory is considered ‘as one of the ten outstanding discoveries of astronomy and astrophysics since the discovery of the telescope, in 1608, by Galileo’.Early 1920s announced the arrival of Indian scientists to the world. Between 1920-25, Indian scientists made path-breaking discoveries and inventions that got global recognition and went on to inspire many young professionals to work in the field of science.Meghnad Saha, an astrophysicist, was among scientists like C V Raman, Subrahmanyan Chandrasekhar, Ramanujan who gained prominence.Saha gave the world the Thermal Ionisation Equation, also known as the ‘Saha Equation’. Saha’s Equation is his most recognised contribution in astrophysics which related an element’s ionization state to the temperature and pressure. The theory explained the spectral classification of stars.

প্রথিতযশা বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান-সংঘটকের ভূমিকায়, সবাইকে একই সম্ভাবনার সুযোগ করে দেওয়া, জাতি-ধর্ম ভুলে যোগ্যতা অনুযায়ী সবাইকে সমান কর্মযজ্ঞে শামিল করা, যা সাম্যবাদের গোড়ার কথা, তা-ই ছিল মেঘনাদ সাহার জীবনের মূল জীবনদর্শন। কিন্তু তাঁর এই জীবনদর্শনের উৎস কোথায়? উত্তর জানতে পৌঁছে যেতে হবে বিশ শতকের গোড়ার শেওড়াতলি গ্রামে, মেঘনাদ সাহার জন্মস্থলে। অধুনা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরের সেই গ্রাম ব্রিটিশ শাসনের সময় তখন সভ্যতার আলো থেকে বহু দূরে। সেখানেই ১৮৯৩ সালের ৬ অক্টোবর মেঘনাদ সাহার জন্ম। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে ১০ কিলোমিটার দূরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। যাওয়া-আসার দুস্তর সমস্যা। তাই বিদ্যালয়ের কাছাকাছি বসবাসকারী ডাক্তার অনন্ত দাসের বাড়িতে আশ্রয় নেন কিশোর মেঘনাদ। বাড়ির গোয়ালঘর দেখাশোনা, বাসন মাজার মতো কাজ মেঘনাদকে করতে হত। তবেই জুটত খাবার, মাথা গোঁজার ঠাঁই। যদিও কাজগুলো মনের আনন্দেই করতেন তিনি। কারণ, তার বদলে মিলত পড়াশোনার সুযোগ। কিন্তু অনন্ত দাসের বাড়িতে ছিল জাতপাত নিয়ে চূড়ান্ত বাড়াবাড়ি। মেঘনাদ ‘নিচু জাত’-এর ছেলে। তাই বাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশ নিষেধ। নির্দেশ ছিল, নিজের বাসনপত্র গ্রামের পুকুর থেকে নিজেকেই ধুয়ে মেজে আনতে হবে। বাড়ির বাসনের সঙ্গে মিশিয়ে ফেললেই কেলেঙ্কারি। পড়াশোনার জন্য সব মুখ বুজে মেনে নিলেও সংবেদনশীল মেঘনাদের মনে গ্রামের দিনগুলি দাগ কেটে গিয়েছিল।নিজের কৈশোরের অভিজ্ঞতা দিয়েই তিনি বুঝেছিলেন, জাতিভেদ, অসাম্য আসলে সমাজের এক গভীর অসুখ। জাতিভেদ প্রথার কদর্য দিকটা আরও ভাল ভাবে বুঝতে পেরেছিলেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে এসে। তিনি তখন শহরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত সাইকেলে চড়ে গৃহশিক্ষকতা করে বেড়ান। বাকি সময়টা ডুবে থাকেন গণিতে। মেধা বৃত্তি পাওয়ায় তখন সহপাঠীদের সম্ভ্রমের পাত্র মেঘনাদ। কিন্তু এক বার সরস্বতী পুজোর দিন বদলে গিয়েছিল সব কিছু। পুজোমণ্ডপে অঞ্জলি দেওয়ায় মেঘনাদের উপস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল ব্রাহ্মণ ছাত্ররা। ব্যাপারটা এ রকম যে, তুমি যতই মেধাবৃত্তি পাও, আসলে তো ছোট জাত। তাই ব্রাহ্মণদের সঙ্গে এক আসনে বসার যোগ্যতা অর্জন করতে পারো না। মেঘনাদের ব্রাহ্মণ সহপাঠীদের ভাবগতিক এমনই ছিল। এই ঘটনাই জাতিভেদের বিরূদ্ধে আজীবন লড়াই করার বারুদ ভরে দিয়েছিল মেঘনাদের বুকে, যার ছাপ পড়েছিল তাঁর বিজ্ঞান গবেষণা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক মতাদর্শে। সেই সঙ্গে গড়ে উঠেছিল বৈদিক ধর্মের প্রথা, প্রতিষ্ঠান এবং সেগুলিকে ব্যবহার করে হাজার হাজার বছর ধরে চলতে থাকা সামাজিক বিভেদের প্রতি বিদ্বেষ। সেই বিদ্বেষ এমনই জায়গায় পৌঁছেছিল যে তিনি পিতৃদত্ত নাম পর্যন্ত বদলে নিয়েছিলেন। ১৯৯০ সালের ১৪ জানুয়ারি, স্মিথসোনিয়ান ন্যাশনাল এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়ামের কিউরেটর ডেভিড ডিভরকিনকে লেখা এক চিঠিতে মেঘনাদ সাহার বড় ছেলে অজিত সাহা জানিয়েছিলেন, যে দিন তাঁর বাবা জন্মেছিলেন, সারা দিন ধরেই প্রচণ্ড ঝড়-জলের তাণ্ডব। আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী ঝড়-জলের দেবতা দেবরাজ মেঘরাজ ইন্দ্র। তাই দেবরাজ ইন্দ্রের নামানুসারে নবাগত শিশুর নাম রাখা হয়েছিল মেঘনাথ। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুদের বৈদিক ধর্মীয় আচরণের গোঁড়ামি মেঘনাথকে এতটাই বিরক্ত করে তুলেছিল যে, তিনি নিজের নাম পাল্টে রেখেছিলেন মেঘনাদ। যিনি ইন্দ্রজিৎ। দেবতা নন, রাক্ষসদের প্রতিনিধি। সেই থেকে গোটা বিশ্বের কাছে তিনি মেঘনাথ নন, মেঘনাদ নামে পরিচিত হন। তাঁর চোখে মেঘনাদ ইন্দ্রজিৎ সমাজের অপমানিত অংশের প্রতিনিধি, যাঁকে অন্যায় ভাবে বধ করেছিল ব্রাহ্মণ সমর্থিত এক ক্ষত্রিয় রাজপুত্র। শুধু বিজ্ঞান বা রাজনৈতিক মতাদর্শ নয়, নিজের নাম বদলেও মেঘনাদ প্রমাণ করেছিলেন তিনি আসলে ডেমোক্র্যাটিক ক্লাসের প্রতিনিধি, যাদের পিছিয়ে পড়া বলা হয়, জোর করে পিছিয়ে রাখা হয়।আসলে গবেষণায় মগ্ন মানুষটি জীবনে বিশেষ টাকাকড়ি করে উঠতে পারেননি। কিন্তু তা বলে বিদ্যাচর্চায় খামতি থাকেনি। গবেষণাগার থেকে ফিরেও বইয়ের জগতে ডুবে যেতেই পছন্দ করতেন। বাড়িতে ছিল নিজস্ব লাইব্রেরি। রবীন্দ্রনাথ ও শেক্সপিয়রের ভক্ত ছিলেন। অধ্যাপক সাহার বইয়ের সংগ্রহ নিয়ে একটি মজার ঘটনা ঘটেছিল। এক বার পাড়ার ছেলেরা তাঁর বাড়িতে সরস্বতী পুজোর চাঁদা চাইতে গেলে তিনি তাদের নিজের ঘরের বিশাল বইয়ের সম্ভার দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি এই ভাবেই সরস্বতীর আরাধনা করি। চাঁদা তুলে পুজোয় বিশ্বাস করি না।’ আসলে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াকালীন সরস্বতী পুজোয় ব্রাহ্মণ সহপাঠীদের অপমান তিনি ভুলতে পারেননি। ছাত্রাবস্থায় সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে। যোগ্য সহপাঠীর উপস্থিতিও মেঘনাদকে অনেকটাই উৎসাহ জুগিয়েছিল।তাঁর নিজের জীবনটাই যেন নক্ষত্রের প্রচণ্ড তাপ ও চাপের সম্মুখীন হওয়া এক পরমাণুর গল্প, যে কিনা চাপিয়ে দেওয়া সামাজিক বিধিনিষেধে প্রভাবিত হয়নি। দেশের নিচু তলার মানুষের দুর্দশা তাঁকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল ১৯১৩ সালে প্রিয় শিক্ষক প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রেরণায় গড়ে তোলা বন্যাত্রাণ প্রকল্পের দিনগুলি। ১৯৩৫ থেকে ’৫১— এই ১৬ বছর রাজনীতিক ও বিজ্ঞান প্রশাসক মেঘনাদকে আত্মপ্রস্তুতির মঞ্চ গড়ে দেয়। সায়েন্স অ্যান্ড কালচার পত্রিকার হাত ধরে দেশের বিবিধ সমস্যার বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধান নির্দেশ এবং ১৯৩৮ সালে তৎকালীন কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট সুভাষচন্দ্র বসুকে সঙ্গে নিয়ে কংগ্রেসের জাতীয় পরিকল্পনা কমিটি গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে যার সূত্রপাত। এর পরে ঘটে দেশভাগের মতো ঘটনা। ভিটেহারা মানুষদের দুরবস্থা সামনে থেকে দেখেন তিনি। কলকাতায় তখন লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর ভিড়। শরণার্থীদের সাহায্যার্থে একাধিক সম্মেলন, আলোচনাচক্রে যোগ দিয়ে মানুষের দুর্দশার কথা আরও বেশি করে উপলব্ধি করেন অধ্যাপক সাহা। এই সমস্ত ঘটনাই তাঁর সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশের দরজা খুলে দেয়। ১৯৫১ সালের সাধারণ নির্বাচনে মেঘনাদ সাহা নির্দল প্রার্থী রূপে দাঁড়িয়ে বিপুল জয় পান। উল্লেখযোগ্য হল, মেঘনাদ সাহার নির্বাচনী ইস্তাহারে তাঁকে ‘সাম্যবাদী’ বলে অভিহিত করা হয়েছিল। তাঁর প্রচারচিহ্ন ছিল সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের দুই প্রয়োজনীয় হাতিয়ার, কোদাল ও বেলচা। সেখানেও তিনি তথাকথিত নিচুতলার মানুষেরই প্রতিনিধি। তাঁর অগাধ বিজ্ঞান প্রতিভার সঙ্গে এই সামাজিক ও রাজনৈতিক অবদানের জন্য আমরা তাঁর কাছে চির ঋনী।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *