এআইপিসির সাথে কিছুক্ষন

সোমক পালিতের প্রতিবেদন :

গত ২৭ মে বিধানভবনে এআইপিসি’র একটি নতুন অনুষ্ঠান,”এআইপিসির সাথে কিছুক্ষন….”এর সূচনা ঘটলো ।এই অনুষ্ঠানে প্রতিবার কোন একজন, মূলত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে আহ্বান করা হবে অতিথি হিসাবে এবং সমসাময়িক পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রশ্নউত্তরের মাধ্যমে আলোচনা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে দেড় ঘন্টা সময়সীমার মধ্যে।উপস্থিত শ্রোতৃমন্ডলীরাও প্রশ্ন করতে পারবেন অতিথিকে। এআইপিসির রাজনৈতিক শাখা এই অনুষ্ঠানটির পরিচালনা করবে বলে জানান রাজ্য সভাপতি চন্দন ঘোষ।

অনুষ্ঠানের প্রথমটির অতিথি ছিলেন নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটর প্রাক্তন সম্পাদক ও প্রাক্তন সাংসদ ও বিধায়ক দেবপ্রসাদ রায় যিনি মিঠুদা নামে পরিচিত।তাঁকে প্রশ্ন করেন এআইপিসির রাজনৈতিক শাখার প্রধান এআইসিসি সদস্য অমিতাভ সিংহ। তাকে সাহায্য করেন মনিদীপা মন্ডল।

অনুষ্ঠানের প্রথমে চন্দন ঘোষ এই অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত করতে গিয়ে বলেন এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সাধারন মানুষের মনের কথা ও প্রশ্নের প্রতিফলন ঘটবে। পরের বার প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীকে অতিথি হিসাবে পাওয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন চন্দন বাবু। ইতিমধ্যে তাঁকে আমন্ত্রন জানানো হয়েছে বলেও জানানো হয় ।

এ আই পি সি’র রাজনৈতিক বিভাগের প্রধান অমিতাভ সিংহ এরপর মঞ্চে আহ্বান করেন দেবপ্রসাদ রায়কে। দেবপ্রসাদবাবু বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তার সুচিন্তিত মতামত রাখার পর আরম্ভ হয় প্রশ্নত্তোর পর্ব।

তিনি তার সময় ছাত্র আন্দোলন ও ১৯৬৭ ও ১৯৬৯ এর সময় কংগ্রেসের পরাজয় ও যুক্তফ্রন্টের রাজত্বকালে পশ্চিমবঙ্গে চূড়ান্ত অরাজকতা,নকশাল আন্দোলন ও খুনের রাজনীতির কথা উল্লেখ করে বলেন তখন বাংলায় প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সীর নেতৃত্বে তুমুল ছাত্র আন্দোলনের কথা উল্লেখ করেন। একটি প্রশ্নের উত্তেরে রাজীব গান্ধীর সময় তার উদ্যোগে প্রায় ৭০০ ইউথ কোঅর্ডিনেটর নিয়োগ ও তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয় বলে তিনি জানান।তারপর ১৯৮৯সালে কংগ্রেসের পরাজয় ও তারপর রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পর এই উদ্যোগ থমকে যায় বলে তিনি জানান। এইসময়টা তার জীবনে একটা বিশেষ সময় বলে তিনি জানান।

অমিতাভ সিংহের কংগ্রেসের দূর্বল হওয়া ও আঞ্চলিক দলগুলির কয়েকটি রাজ্যে ক্ষমতা দখল সম্পর্কে একটি প্রশ্নের উত্তেরে তিনি বলেন স্বাধীনতার পর যখন দেশের সংবিধান তৈরী করার পদক্ষেপ নেওয়া হয় তখন একটি প্রস্তাব ছিল প্রতিটি রাজ্যে আলাদা আলাদা সংবিধান,যেমন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে আছে সেরকম কিছু করা যায় কিনা। তখন সংবিধান প্রনেতারা এটা স্বীকার করেন নি।কংগ্রেস যদি প্রতিটি প্রদেশ কংগ্রেসের জন্য পৃথক সংবিধান তৈরী করত তাহলে আঞ্চলিক স্বার্থে মনোযোগ দেওয়া যেত ও এভাবে আঞ্চলিক দলগুলি কয়েকটি রাজ্যে প্রভাব বিস্তার করতে পারত না।তাছাড়া এখন দেশে মাত্র গুটিকয়েক রাজ্যে আঞ্চলিক দলের সরকার চলছে।আগামী দিনে সেই রাজ্যের মানুষ যখন আঞ্চলিক দলগুলির সীমাবদ্ধতা বুঝতে পারবেন, আমরা নিয়মিত মানুষের সাথে যোগাযোগ পুনরায় তৈরী করে ও তাদের সাথে একাত্ম হয়ে তখন আবার সরকার গঠন করতে পারব।আঞ্চলিক দলগুলি দাঁড়িয়ে আছে আঞ্চলিক উপজাতীয়তাবাদের ওপর।এই উপ- জাতীয়তাবাদের সমষ্টি হল ভারতীয় জাতীয়তাবাদ যা রবীন্দ্রনাথ ‘মহাজাতি’ শব্দটির মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছিলেন।

কংগ্রেসের ইডিওলজি বা মতাদর্শ সম্পর্কে তার বক্তব্য ছিল নেতৃত্ব বা ক্ষমতার চেয়ে বেশী সমস্যা মতাদর্শের। আমরা স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ও তারপর দেশ গড়ার কাজে আমাদের যে মতাদর্শ মানুষের মধ্যে নিয়ে যেতে পেরেছিলাম তা আজ আর পারছি না এটা স্বীকার করে নেওয়া ভাল।আমরা গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী।সবধর্মকে সমানভাবে দেখার তত্বে বিশ্বাসী। সকলের সমানাধিকারে বা সমতায় বিশ্বাসী।গণতন্ত্রের ধারণাটা রয়েছে স্বাধীনতার মধ্যে সাম্য।

আমরা এখন বাজার অর্থনীতির দিকে এগিয়েছি,তার ফলে তৈরী হয়েছে উপভোক্তাদের বাজার।এই পরিবর্তনের মত আমাদের কাজকর্মের ধারার পরিবর্তনও দরকার।রাজীব গান্ধী সেটা বুঝতে পেরেছিলেন বলেই দেশের সাথে সাথে দলকে একবিংশ শতাব্দীতে নিয়ে যেতে পরিকল্পনা নিয়েছিলেন।সাম্প্রতিককালে শিক্ষার অধিকার, ১০০ দিনের কাজের অধিকার, তথ্যের অধিকার,জঙ্গলের অধিকার,খাদ্য নিরাপত্তা সবই অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতির উদাহরণ। এসবই বহুত্ববাদী চরিত্রকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে একটি প্রশ্নের উত্তরে তার বক্তব্য ছিল জাতীয়তাবাদ ও হিন্দুত্বের মধ্যে দলকে একটা ভারসাম্য আনতে হবে ক্ষমতায় আসার জন্য।ভারত কিভাবে সৃষ্টি হল তা নিয়ে গবেষকদের সাথে আলোচনা করা যেতে পারে।এঅাইপিসি ভারতের ধারনা বা ভারত সম্পর্কে ভাবনা বিষয়ে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারে ।রাজনৈতিক পরিধির বাইরে বৈচিত্র্য আমাদের সম্পদ।এটা নষ্ট করার চক্রান্ত হচ্ছে।একসময় প্রভাবশালী ইসলাম শাসন ছিল, এরপর মোঘল সাম্রাজ্যর প্রভাব কমে গেলে আহমেদ শাহ আবদালীর শাসন এল।পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে চল্লিশ হাজার মারাঠা মারা গেল হিন্দু রাজা ও শাসকদের ঐকযমতের অভাবে। কোন হিন্দু তাদের রক্ষা করতে না আসায় জাতীয়তাবাদের চেতনার পরাজয় হয়।প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ২৬০০০ ব্রিটিশ সৈন্য ও ২৭৪০০০ হিন্দের সৈন্য থাকলেও ঐক্যের অভাবে জয় আসে নি একই কারণে। ব্রিটিশরা ভারতকে দুইভাগে ভাগ করেছিল,একটা হল ভারতীয় রাজ্য, অন্যটা ব্রিটিশ ভারতীয় রাজ্য। আমরা জাতীয়তাবাদের চেতনা ও বহুত্ববাদী চরিত্রকে স্বীকার করতে ব্যর্থ হয়েছি।আমরা এখন আর স্বাধীনতা আন্দোলনের বহুত্ববাদী চরিত্র ও আঞ্চলিক আশা আাকাঙ্খাগুলিকে সন্মান দিই না। ফলে সাম্প্রদায়িক সমস্যাগুলি প্রাধান্য পেয়েছে ও বহুত্ববাদী ধারনাটা পেছনে চলে গেছে। মনে রাখতে হবে হিন্দু শব্দটির উৎস বিদেশে।ভারত শব্দটি কলিঙ্গরাজ অশোকের সময়।বর্তমানে দেশের একচেটিয়া হিন্দুত্ববাদীদের আধিপত্য ভাঙতে গেলে ভারতের বহুত্ববাদী রূপটা খুঁজে বার করা গুরুত্বপূর্ণ। রাজীব গান্ধীর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ৬৪ তম সংশোধনীর মাধ্যমে গণতান্ত্রিকভাবে জনগনকে ক্ষমতা প্রদান করা। গ্রাম পঞ্চায়েতে আধিপত্য বিস্তার করতে গেলে স্থানীয় সমস্যা নিয়ে কাজ করতে হবে। পঞ্চায়েতের সভা ঠিকমত হচ্ছে কিনা বা সভায় নেওয়া সিদ্ধান্ত কার্যকর হচ্ছে কিনা।আমরা ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত সময় পেয়েছিলাম দলকে শক্তিশালী করতে,যা করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। এরাজ্যের মত সব রাজ্যে আমাদের স্থানীয় আকাঙ্খাগুলির মধ্যে ভারসাম্য আনতে হবে।তাহলেই মোদী যে নির্বাচিত স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা করেছে তা ভাঙা যাবে।তার শক্তি শুধু হিন্দুত্ব নয় ৪০ শতাংশ ওবিসির ভোট যা মনে রাখতে হবে।পরিবারতন্ত্র সম্পর্কে দেবপ্রসাদবাবুর বক্তব্য ছিল আমরা এই অভিযোগের উত্তর ঠিকমত দিতে পারছি কই? জওহরলাল,ইন্দিরা বা রাজীব গান্ধী তো দেশকে সফলভাবে চালিয়েছেন।কংগ্রেস পরিবারের পরের প্রজন্মকে দেশসেবার কাজে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছি তাদের অনেকে শহীদ হওয়া সত্বেও। হয়তো আরো দর্শকের মধ্যে আরো প্রশ্ন ছিল কিন্তু নির্ধারিত সময় অতিক্রান্ত হওয়ায় অনুষ্ঠানর সমাপ্তি হয় এআইপিসির রাজ্য সম্পাদক রাজদীপ ব্যানার্জীর

ধন্যবাদ জ্ঞাপনের মাধ্যমে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *