বিষয় – মণিপুর, সরকার ও মিডিয়া নিঃস্পৃহ কেন

(সৌরভ কুন্ডু’র প্রতিবেদন)

মণিপুরে হিংসার ঘটনায় রাজ্যের মানুষের বা সম্পদের যা ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে তার তো সীমা পরিসীমা নেই, কিন্তু তার সাথে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আপনাদের বোঝা দরকার কেন অবিলম্বে মণিপুরের দীর্ঘ ৫০ দিনের ওপর চলতে থাকা এই হিংসা বা দাঙ্গা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। নাহলে, দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের অসম্ভব ক্ষতি হতে পারে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বার বার দেশের প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আবেদন জানানো সত্বেও প্রধানমন্ত্রী একবারের জন্যও মণিপুরের নাম মুখে আনেন নি, সর্বদলীয় বৈঠকের আবেদনে কর্ণপাত করেন নি। উল্টে গতকাল তিনি ড্যাংড্যাং করে আমেরিকা সফরে চলে গেলেন, যেন কিছুই হয় নি। আর নখদন্তহীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, যাকে আদৌ কেউ গুরুত্ব দেয় বলে মনেই হয় না, তিনি হিংসার বাতাবরণ শুরু হওয়ার ২৭ দিন পরে মণিপুরে ক্ষমাঘেন্না করে একবার পদার্পণ করেছিলেন বটে, কিন্তু বিবদমান দুই গোষ্ঠী যথারীতি তাঁকে কোন পাত্তাই দেয় নি। এবার আসল বিষয়ে আসিঃ

মণিপুরের পূর্ব সীমানা, যা ভূতত্ত্বে (Geology) ওফিওলাইট বেল্ট নামেও পরিচিত, সেটি উত্তরে জেসামি (উখরুল জেলা) থেকে দক্ষিণে মোরেহ (টেংনোপাল জেলা) পর্যন্ত বিস্তৃত এবং যে অঞ্চলগুলি চুনাপাথর, ক্রোমাইট এবং পিজিই (অর্থাৎ প্ল্যাটিনাম গ্রুপের ধাতব খনিজ যেমন প্ল্যাটিনাম, নিকেল, ক্রমিয়াম, ভ্যানাডিয়াম ) এর মতো ধাতব ও অধাতব খনিজে সমৃদ্ধ।

তামেংলং, জিরিবাম, চুরাচাঁদপুর এবং ফেরজাওল জেলার কিছু অংশ সহ মণিপুরের পশ্চিম প্রান্ত হাইড্রোকার্বন ( অর্থাৎ তেল ও গ্যাস ) সমৃদ্ধ এবং সেটি মূলত আসাম-আরাকান অববাহিকার অধীনে পড়ে।

ভূতত্ত্ববিদদের ( আমার বিষয় বলে আমি নিজেও জানি ) অসম্ভব পরিশ্রমের ফলশ্রুতি হিসেবে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে এই অঞ্চলে গ্যাসের ভালো মজুদ থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আছেও । এলাকাটিতে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ (আবার বলছি, তেল নয় কিন্তু) থাকার খুব উচ্চ সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে।

এর প্রাপ্যতা, গুণমান এবং পরিমাণ নিশ্চিত করার জন্য, কোন একটি সংস্থা ( নাম জানানোর প্রয়োজন এই মুহূর্তে নেই ) অতি ভারী এবং বড় মেশিনের সাথে গভীর ড্রিলিং করার প্রস্তাব করেছে।আবারও বলছি, প্রত্যন্ত এলাকাটিতে প্রচুর পরিমাণে গ্যাসের মজুদ (তেল নয়) থাকার খুব উচ্চ সম্ভাবনা রয়েছে বলে গবেষণায় জানা গেছে। বিস্তৃত পাহাড় মণিপুর রাজ্যের প্রায় ৯০% ভূমি দখল করে আছে অথচ উপত্যকা যেখানে মাত্রই ১০% ভূমি, শুনলে আশ্চর্য হবেন, সেখানে প্রায় ৬০% লোকের বাসস্থান।মণিপুর রাজ্যের জনসংখ্যার বিচারে প্রায় ৫৩% মেইতিই সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করে, তারপরে বিভিন্ন নাগা জাতিগোষ্ঠী যারা শতাংশের বিচারে নয় নয় করেও প্রায় ২৪% এবং বিভিন্ন কুকি/জো উপজাতি (যারা চিন-কুকি-মিজো সম্প্রদায় নামেও পরিচিত) তারা প্রায় ১৬%। অতএব, দেখাই যাচ্ছে, মণিপুরের এই ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী বিভিন্ন ধর্ম ও রীতিনীতি পালন করে।২০১১ সালের ভারতে যে আদমশুমারি হয়েছিল সেই অনুসারে মণিপুরের ৪১.৩৯% জনসংখ্যাই হিন্দু ধর্ম পালন করে। আর খ্রিস্টধর্ম মেনে চলেন ৪১.২৯% মানুষ। শুনলে অবাকই হবেন যে মেইতিইরা শুধুমাত্র দুটি ধর্মকেই অনুসরণ করে, যার মধ্যে সিংহভাগ মেইতিই হিন্দু ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন রীতিনীতি পালন করে। এঁরা একটি নির্দিষ্ট রীতিই পালন করে তা কিন্তু নয়। আবার এই মেইতিইদের প্রায় ১৬% ঐতিহ্যগতভাবে সানামাহি ধর্মে বিশ্বাস করে যার ঈশ্বর হলেন সানামাহি। এই মেইতিইরা হিন্দু ধর্মের পাশাপাশি সানামাহি ধর্মীয় ঐতিহ্য এবং আচার-অনুষ্ঠান অর্থাৎ উভয়ই অনুসরণ করে। কিন্তু মেইতিইদের মধ্যে যারা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সদস্য, তারা আবার বিভিন্ন আচার ধর্মে বিশ্বাসী, নির্দিষ্ট একটা নয়। কুকিদের আবার অধিকাংশই এখন খ্রিস্টান, যাদের বেশিরভাগই আবার প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ের, বিশেষ করে তারা ব্যাপটিস্ট। নতুনত্ব হল, বিংশ শতকের শেষের দিক থেকে, এই সম্প্রদায়ের মধ্যে কিছু মানুষ আবার মেসিয়ানিক ইহুদি ধর্ম অনুসরণ করতে শুরু করেছে। নতুন একটি ধারা বলতে পারেন। তবে, ধর্মীয় আচার আচরণ, রীতিনীতি পালন, বিশ্বাস – এগুলি মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার। প্রশ্ন সেটি নয়। এটাও ঠিক, এই ধর্মীয় বিন্যাসটি না বোঝালে মুল বিষয়ে যাওয়া যেতও না । প্রকৃতপক্ষে সমস্যাটা অন্য জায়গায়। নাগা এবং কুকি-চিন উপজাতিরা পার্বত্য অঞ্চলের প্রায় সেই ৯০% ভুমি দখল করে আছে যেখানে বেশিরভাগই মূল্যবান খনিজ ও পেট্রোলিয়াম গ্যাস বিদ্যমান। কিছু বোঝানো গেল ? অন্বেষণ, নিষ্কাশন এবং এই বিশেষ পার্বত্য অঞ্চলে প্রবেশাধিকারের সহজতার জন্য, সরকারী কর্তৃপক্ষ বা কর্পোরেট সংস্থাগুলি এই বিস্তৃত অঞ্চলের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রন পেতে চায় ( সেটাই স্বাভাবিক ) এবং স্থানীয়দের পূর্ণ সহযোগিতা চায় ( তাও হয়ত অস্বাভাবিক নয় ), যা প্রাচীন কাল থেকেই কুকি সম্প্রদায়ের দখলে ছিল। এই অঞ্চলে নাগা সম্প্রদায়ের মানুষও রয়েছেন, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন আবার সশস্ত্র বিদ্রোহী। সমস্যাটা কিন্তু এখানেই। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭১ সি অনুসারে, ভারতের রাষ্ট্রপতিকে, মণিপুরে বিশেষ বিধানসহ এই পার্বত্য অঞ্চলের নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে, বিধানসভায় একটি বিশেষ কমিটি গঠনের অনুমোদন দেয়।অবাক হওয়ার কিছু নেই যখন আপনারা জানবেন যে ভারতের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত ছবির মত এই মণিপুর রাজ্যের ইতিহাস প্রায় দুই হাজার বছরের পুরনো । আজ পর্যন্ত যা যা ঘটনাবলী মণিপুরে সংঘটিত হয়েছে, তা চৈথারোল কুম্বাবা (রয়্যাল ক্রনিকলস) নামে একটি ডায়েরির মত গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। মণিপুর রাজ্যের শেষ শাসক ছিলেন মহারাজা বোধচন্দ্র সিং। তিনি ১৯৪১ থেকে ১৯৪৯ সালের মধ্যে মণিপুর রাজ্য শাসন করেছিলেন।মণিপুরে প্রধান কমিশনারের কার্যালয়, ১৯৬৯ সালে লেফটেন্যান্ট গভর্নরের কার্যালয়ে পর্যবসিত হয় এবং ২১ জানুয়ারী, ১৯৭২-এ মণিপুর যখন ভারতীয় ইউনিয়নের একটি সাংবিধানিক রাজ্য হয়ে ওঠে তখন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের মর্যাদা গভর্নরে পরিবর্তিত করা হয়। কংগ্রেস মুখপাত্র ও প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শ্রী জয়রাম রমেশ মণিপুরে সংঘটিত এই বিবদমান পরিস্থিতির জন্য কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে সঠিক কারণেই অভিযুক্ত করেছেন, বিশেষত আমরা সবাই জানি এই অস্থিরতার রাজনীতি, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের ( আরএসএস ) আদর্শ দ্বারা পরিচালিত বিজেপি দলের রাজনীতির ব্র্যান্ড, তাদের কায়েমি স্বার্থের কারণে তারা সারা দেশেই ইচ্ছাকৃত ভাবে এই রকমের অস্থিরতার পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে। উপরে উপরে দেখলে কিন্তু মনে হবে উপত্যকার মেইতিই অধিবাসীদের দ্বারা কুকি পার্বত্য উপজাতির লোকেদের উপর আক্রমণ করা হচ্ছে। ঘটনার ব্যাপ্তি কিন্তু আরও গভীরে। ভূগর্ভস্থ গুপ্তধনের ভাণ্ডারে অর্থাৎ পেট্রোলিয়াম গ্যাস এবং পৃথিবীর বিরলতম খনিজ পদার্থগুলির গুপ্ত বিশাল ভাণ্ডারে সহজে প্রবেশাধিকার পাওয়ার জন্য কর্পোরেটদের অসম্ভব তাগিদ ও অনুপ্রেরণা বোঝাটাও অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত, হিন্দু-খ্রিস্টান বা হিন্দু-মুসলমান বা বিভিন্ন জাতি – উপজাতির মধ্যে সংঘর্ষ বা হিংসা বরাবরই আমাদের দেশের তথাকথিত মিডিয়ার জন্য বিরাট খোরাক, কিন্তু যেহেতু প্রধানমন্ত্রী মোদি এই মুহূর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে আছেন, তাই এই ধরনের সংঘর্ষের বা মণিপুর হিংসা নিয়ে বিস্তারিত প্রচার মিডিয়ায় পরিবেশিত হলে এটি আন্তর্জাতিক মহলে বিরাট সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। কর্পোরেট ( যাদের মধ্যে কারও কারও হয়ত বা মণিপুরের পেট্রোলিয়াম গ্যাস এবং পৃথিবীর বিরলতম খনিজ পদার্থগুলির উপরও নজর আছে ) মালিকানাধীন গোদি মিডিয়া তাই বিগত ৫২ দিন ধরে চলতে থাকা মণিপুরের তীব্র অশান্তি ও হিংসা সম্পর্কে সম্পূর্ণ নীরব থাকাটাই শ্রেয় বলে বিবেচনা করে।উপরের দেওয়া তথ্যগুলি সংযোগ করার চেষ্টা করলেই বুঝতে পারবেন কেন সরকারের বা মিডিয়ার মণিপুরের হিংসা দমন করার জন্য বিশেষ কোন তাগিদ নেই। শুধু কুকি আর মেইতেই সম্প্রদায়ের ঘাড়ে বন্দুক রেখে,নিজেদের আখের গোছানোর ধান্ধা করছে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *