পন্ডিত নেহরুর নাম অপসারণ করে ইতিহাস পাল্টানো যাবেনা।

মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার দিল্লির তিনমূর্তি ভবনে অবস্থিত নেহরু মেমোরিয়াল মিউজিয়াম ও লাইব্রেরির নাম পরিবর্তন করে প্রধানমন্ত্রী মেমোরিয়াল মিউজিয়াম ও লাইব্রেরী করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। গত ১৫ জুন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই মেমোরিয়াল মিউজিয়াম ও লাইব্রেরী সোসাইটির বিশেষ বৈঠকে উপরোক্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।প্রধানমন্ত্রী মোদি এই সোসাইটির সভাপতি ও রাজনাথ সিংহ সহ সভাপতি।এর আগে ২০১৬ সালে নরেন্দ্র মোদির প্রস্তাব অনুযায়ী এই সংগ্রহশালাকে দেশের সমস্ত প্রধানমন্ত্রীর স্মৃতির উদ্দেশে উৎসর্গ করা হয়। ওই বছরই তিনমূর্তি ভবন প্রাঙ্গণে এই মিউজিয়ামের জন্য একটি নতুন ভবন তৈরির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন নরেন্দ্র মোদি । গত বছর এই নতুন ভবনটি খুলে দেওয়া হয়েছে। সেখানে নরেন্দ্র মোদির জীবন ও কর্মের ওপর একটি বিশেষ গ্যালারি স্থাপন করতে চলেছে মোদি সরকার।এবার পন্ডিত নেহরুর নামটিও অপসারণ করল মোদি সরকার। মনে রাখতে হবে এই প্রতিষ্ঠান একটি অসাধারণ গবেষণা কেন্দ্র। স্বাধীনতা আন্দোলনের দুষ্প্রাপ্য সব নথিপত্র রয়েছে এখানে। সেগুলি স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে পড়ে কী হবে তাই নিয়ে ঐতিহাসিকরা শঙ্কিত।

দেশ স্বাধীন হবার পর প্রধানমন্ত্রী নেহরু এই তিনমূর্তি ভবনে ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত , মোট ১৬ বছর বাস করেন।১৯৬৪ সালের ২৭ মে তাঁর প্রয়াণের পর ১৯৬৪ সালের ১৪ নভেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন পন্ডিত নেহরুর জন্মদিবসে তাঁর নামাঙ্কিত এই মিউজিয়াম ও লাইব্রেরীটি জাতির উদ্দেশে উৎসর্গ করেন। ২০১৬ সালেই বোঝা গিয়েছিল যে মোদি সরকার পন্ডিত নেহরুর নামটি এখান থেকে অপসারণ করবে। হিন্দুত্ববাদি সাম্প্রদায়িক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ ও ভারতীয় জনতা পার্টির মতাদর্শগত প্রধান শত্রু মহাত্মা গান্ধি ও পন্ডিত জহরলাল নেহরু।কিন্তু এই মৌলবাদীরা জানে না এইভাবে নাম বদলিয়ে ইতিহাস পাল্টানো যায়না। কিন্তু ইতিহাসকে বিকৃত করার প্রচেষ্টায় কোনো অন্ত নেই।বেশিদিন আগে নয়,২০১৪ সালের ১৭অকটোবর রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের মালয়ালাম ভাষায় প্রকাশিত মুখপত্র ‘কেশরী ‘তে কেরালার এক বিজেপি নেতা বি.গোপালকৃষ্ণন একটি নিবন্ধ লেখেন। নিবন্ধটিতে গোপালকৃষ্ণন লেখেন নাথুরাম গডসের উচিৎ ছিল গান্ধির পরিবর্তে জওহরলাল নেহরুকে হত্যা করা।নাথুরাম লক্ষ্য নির্ধারণে ভুল করেছিলেন।লক্ষ্যনীয় নিবন্ধটিতেখুনী নাথুরামের হিংস্র কাজকে নিন্দা করা তো দূরের কথা তার খুনের লক্ষ্য (Target) নিয়ে বিশেষজ্ঞসুলভ মতামত দেওয়া হয়েছে।এই নিম্ন স্তরের বক্তব্যের জন্য গোপালকৃষ্ণন কার্যত বিজেপি ও আরএসএস এর নেতৃত্বের অনুমোদন পেয়েছেন।এই নেতৃত্ব এটি গোপালের ব্যক্তিগত মত বলে দায় সেরেছেন। মহাত্মা গান্ধিকে হত্যার পর হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি তীব্র জনরোষের সম্মুখীন হয়।ফলে তারা পন্ডিত নেহরুকে হত্যা করার পরিকল্পনা কার্যকর করতে পারেনি।কিন্তু ওই সময় থেকেই তাদের রাজনৈতিক আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য নেহরু।এই সাম্প্রদায়িক শক্তির মতন আর একজন ব্যক্তির আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিলেন মহাত্মা গান্ধি ও পণ্ডিত নেহরু।এই ব্যক্তিটি হলেন কট্টর সাম্রাজ্যবাদী ও ভারত বিরোধী উইনস্টন চার্চিল।ইনি গান্ধিজি সম্পর্কে বলেছিলেন ‘ অর্ধ নগ্ন ভারতীয় ফকির ‘ (হাফ নেকেড ইন্ডিয়ান ফকির)।আমাদের স্বাধীনতার প্রাক্কালে চার্চিল বলেছিলেন ‘ উই আর টার্নিং ওভার ইন্ডিয়া টু ম্যান অফ স্ট্র লাইক দ্য কাস্ট হিন্দু মিস্টার নেহরু, অফ হিম ইন এ ফিউ ইয়ার্স নো ট্রেস উইল রিমেন ‘। অর্থাৎ ‘আমরা ভারতকে তুলে দিয়ে যাচ্ছি বর্ণহিন্দু মিস্টার নেহরুর মতন খড়ের মানুষের হাতে, ক’বছরের মধ্যে আর যাদের খুঁজে পাওয়া যাবেনা’।

১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার এক দশকের মধ্যেই উইনস্টন চার্চিলকে স্বীকার করতে হয়েছিল যে নেহরু একজন ভয়লেশহীন মানুষ।তিনি খড়ের মানুষ নন, লোহার মানুষ। ‘এশিয়ার আলো ‘,তাঁর সম্পর্কে এই কথাটা নেহেরুর মৃত্যুর ক-বছর আগে বলেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন ফিটজেরাল্ড কেনেডি। তিনি বলেছিলেন নেহরুর জোট নিরপেক্ষ নীতি হয়তো আমেরিকার পক্ষে বিরক্তির কারণ হতে পারে ‘বাট ইট ডাস মিন দ্যাট ইন্ডিয়া ম্যাটার্স ‘। স্বাধীন ভারতের এই স্বীকৃতি ও সম্মান যদি কোনও বিশেষ একজনের কৃতিত্ব হয় তা অবশ্যই আমাদের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরুর।

মহাত্মা গান্ধি বলেছিলেন ” অনেকে বলছেন জওহরলালের সঙ্গে আমার বিচ্ছেদ হয়েছে ও মতের অমিল হয়েছে। জওহর বলে ‘ সে আমার ভাষা বোঝে না।’আমিও বলি বিদেশি প্রাণের মিলে সে যে ভাষায় কথা বলে তা আমারও অনেক সময় বোধগম্য হয় না।কিন্তু আমাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটানো অসম্ভব ।কারণ আমি জানি , যখন আমি থাকবো না তখন আমার ভাষায় জওহরই কথা বলবে। রাজাজি নয় সর্দার প্যাটেল নয় সেই আমার প্রকৃত উত্তরাধিকারী।” মহাত্মার উত্তরাধিকারী জওহরলাল ছিলেন ও এখনও আছেন হিন্দুত্ববাদী সংঘ পরিবারের অর্থাৎ মাধব সদাশিবরাও গোলওয়ালকার থেকে নরেন্দ্র মোদি পর্যন্ত সবার হিট লিস্টে এক নম্বরে।

নেহরুকে কেউ বলেছেন প্রাচীনপন্থী।কেউ বলেছেন নাস্তিক।কেউ তাঁকে বলেছেন কল্পনাবিলাসি। কারও মতে তিনি ট্র্যাজেডির নায়ক,হ্যামলেট।রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হ্যারল্ড ল্যাক্সি তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, সমসাময়িক কালের বিশ্বে সবচেয়ে চলমান জননেতা।

প্রজাতন্ত্রী সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষতা, পরিকল্পিত উন্নয়ন, জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি পণ্ডিত নেহরুর চিন্তার ফসল।তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠান গড়ার মনোযোগী কারিগর।যোজনা কমিশন ,সমষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প,ভাখরা নাঙ্গাল, ডি.ভি.সি, এ্যটোমিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট, টাটা ইনস্টিটিউট ফর ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ,মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র, দুর্গাপুর, বোকারো, ভিলাই, রাঁচি হেভি ইঞ্জিনিয়ারিং , চিত্তরজন লোকোমোটিভ, আইআইটি, আইআইএম আরও কত কিছুইনা পণ্ডিত নেহরুর চিন্তা ও দূরদর্শিতার পরিচয় বহন করছে। তিনি এগুলিকে বলতেন ‘ টেম্পলস অফ মডার্ন ইনডিয়া ‘।এই দেশের স্বয়ম্ভর অর্থনীতির ভিত্তি এই বিশাল রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলিকে এখন পুঁজিপতিদের তল্পিবাহকরা জলের দরে কর্পোরেট পুঁজির হাতে তুলে দিচ্ছে।পন্ডিত নেহরু যা সৃষ্টি করে গিয়েছেন সেগুলিকে এক এক করে ধ্বংস করাই এখন এই হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রধান কাজ।

পণ্ডিত নেহরুর সময় কোনও মসজিদ ধূলিস্যাৎ হয়নি, ‘মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে’ বলে কেউ সারা দেশে দাঙ্গা বাঁধাতে পারেনি।তিনি যা করেছেন গণতান্ত্রিক উপায়ে, অধিকাংশের সম্মতির ভিত্তিতে,সংবিধান মেনে।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যেসব দেশ স্বাধীন হয়েছে, ভারতই তার মধ্যে একমাত্র দেশ যেখানে এখনও প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবহমান।পণ্ডিত নেহরুর স্বপ্নের ফসল।

কেউ একজন লিখেছিলেন ওঁর মাথায় ‘গান্ধিটুপি’ যেমন মানায় তা আর কারোর মাথায় মানায়না।গান্ধিজির সচিব মহাদেব দেশাই বলেছিলেন ওঁর চরকা থেকে শুধু সরু সুতোই বের হয়।জেলখানায় ওঁর প্রায় ১০ বছর সময় কেটেছে।কারাজীবনে তিনি ‘ গ্লিম্পসেস অফ ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি ‘, ‘অটোবায়োগ্রাফি ‘ , ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া ‘র মতন বই লিখেছেন যা বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ যাঁকে সম্বোধন করেছিলেন ‘ঋতুরাজ’ বলে।তিনি আমাদের প্রথম প্রধানমন্ত্রী স্বাধীন ভারতের রূপকার জওহরলাল নেহরু।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *