পঞ্চায়েত নির্বাচন এবং পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলী (টিএমসি) হিংসা

(সৌরভ কুন্ডুর প্রতিবেদন)

ভূমিকা: পশ্চিমবঙ্গ পূর্ব ভারতের এমন একটি রাজ্য, সেখানে যে কোন নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সংঘর্ষের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। তা সে পুরনো বামফ্রন্টের আমলই হোক আর হালফিলের তৃণমূলের (টিএমসি) আমলই হোক । আর পঞ্চায়েত নির্বাচন, যা স্থানীয়ভাবে স্বশাসনের জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন করার জন্য পরিচালিত করা হয়, তা তো প্রায়ই হিংসার শিকার হয়। আপনারা তো সকলেই প্রায় জানেন, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন দল তৃণমূলের বিরূদ্ধে বিরোধী দলগুলিকে, বিশেষ করে কংগ্রেসকে বলপূর্বক দমন করতে এবং নিজের শক্ত ঘাঁটি বজায় রাখার অন্যতম উপায় হিসাবে বারবার সহিংস ব্যবহার করার অভিযোগ উঠেছে।

আমার এই নিবন্ধটির মূল লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনের ( সময়কাল ২০০৮ – ২০২৩) সময়। যদিও বিগত দুটি করে বিধানসভা (২০১৬ এবং ২০২১) ও লোকসভা (২০১৪ এবং ২০১৯) নির্বাচনেও টিএমসি-এর সাথে হিংসা প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছে। কিছু বিশেষ ঘটনার উপর আলোকপাত করলে, এই রাজ্যের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হওয়া বিরোধী দলগুলি যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয় তার একটি আভাস প্রদান করা যাবে বলে আমার বিশ্বাস। তবে আমি এখানে মূলত পঞ্চায়েত নির্বাচন আর কিছুটা বিধানসভা নির্বাচন নিয়েই আলোচনাটি সীমিত রাখব।

১) ২০০৮ এর পঞ্চায়েত নির্বাচন :

যদিও ২০০৮ সালে তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসে নি তবে পট পরিবর্তনের একটা আভাস সিঙ্গুর আন্দোলনের পর থেকেই বোঝা যাচ্ছিল।হাড্ডাহাড্ডি বা তুল্যমূল্য লড়াই এর একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে গেছিল। তৎকালীন ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট ও আগের লোকসভা নির্বাচনে শোচনীয় ফল করা তৃণমূল – দুদলই আপন অস্ত্রাগার সাজিয়ে রীতিমতো রণহুংকার দেওয়া শুরু করে দিয়েছিল। যার ফলশ্রুতি হিসেবে আমরা দেখি ২০০৮ এ অনুষ্ঠিত পঞ্চায়েত নির্বাচন, যুগপৎ সিপিএম ও টিএমসি দ্বারা নিযুক্ত ব্যাপক ও চূড়ান্ত হিংসা এবং ভয় দেখানোর কৌশল দ্বারা চিহ্নিত হয়েছিল। তখন বিরোধী দলগুলি, বিশেষ করে ততকালীন টিএমসি এবং জাতীয় কংগ্রেস, বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে আপন ক্ষমতা সুসংহত করা এবং ভিন্নমত দমন করার জন্য সন্ত্রাসের আশ্রয় নেওয়ার অভিযোগ করেছে। সংঘর্ষ এবং বিরোধী দলের, বিশেষ করে কংগ্রেস কর্মীদের উপর হামলা, বুথ দখলের অসংখ্য ঘটনা তখন আমরা সংবাদপত্রে ও টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছি। বিরোধী তথা কংগ্রেস প্রার্থীদের যেভাবে হুমকি ও জবরদস্তির শিকার হতে হয়েছিল বা তাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অবাধে অংশগ্রহণ করতে বাধা দেওয়া হয়েছিল, তা লোমহর্ষক হিন্দি সিনেমাকেও হার মানায়। সে বছর নির্বাচনের প্রাক্কালে সিঙ্গুরে এরকম একটি উল্লেখযোগ্য সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছিল যেখানে বামফ্রন্টের সমর্থকদের সাথে বিরোধী সমর্থকদের বিশেষ করে কংগ্রেস ও টিএমসি কর্মীদের সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার খবরে পশ্চিমবঙ্গবাসী চমকে উঠেছিল। এই সংঘর্ষের ফলে বহু কংগ্রেস (ও টিএমসি) কর্মী হতাহত হয়, ফলত পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরে ভয় ও আতঙ্কের পরিবেশ আরও গভীর হয়। এই ধরনের ঘটনাপ্রবাহ পশ্চিমবঙ্গে যথারীতি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ন্যায্যতা এবং অখণ্ডতা নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ তৈরি করেছে। সারা ভারতের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে আমরা সক্ষম হয়েছি, তা সে যতই নেতিবাচক হোক।

২) ২০১৩ এর পঞ্চায়েত নির্বাচন :

টিএমসি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন। সন্ত্রাস আর রিগিং-এ রীতিমত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। যার ফলে ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চায়েত নির্বাচনেও উচ্চ স্তরের সন্ত্রাস, হিংসা ও খুনোখুনি এবং ফলস্বরূপ প্রভূত বিতর্ক দেখা দেয়। সে বছর ( আজকের এই দুর্নীতির মেদগ্রস্ত টিএমসি তখনও হয় নি, প্রক্রিয়া চলছিল যদিও ) ক্রমাগত টিএমসির বিরুদ্ধে, বিরোধীদের বিশেষ করে জাতীয় কংগ্রেস ও সিপিএম এর প্রভাব দমন করার জন্য শক্তিশালী হার্মাদবাহিনী ব্যবহার করার অভিযোগ করেছে। ভোটে ব্যাপক কারচুপি, বুথ দখল ও বিরোধী দলের কর্মীদের ওপর হামলার খবর পাওয়া গেছে। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা আহত ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। তদুপরি, অনেক বিরোধী প্রার্থীকে মনোনয়ন জমা দিতে বাধা দেওয়া হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে আরও ক্ষুণ্ন করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।নন্দীগ্রামের ঘটনা, যেখানে মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় চূড়ান্ত হিংসা দেখা গিয়েছে, তা উল্লেখযোগ্য ভাবেই সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করে। টিএমসি কর্মীরা ক্রমাগত কংগ্রেসসহ বাকি বিরোধী প্রার্থী এবং সমর্থকদের উপর হামলা চালিয়ে তাদের আহত করেছেন বলে অভিযোগ। নন্দীগ্রামের হিংসা পশ্চিমবঙ্গের গণতন্ত্রের ভঙ্গুর অবস্থার একটি ভয়াবহ অনুস্মারক হিসাবে আজও চিহ্নিত। নেতাই এর ঘটনাও মানুষের স্মৃতিতে সমুজ্জল।

৩) ২০১৮ এর পঞ্চায়েত নির্বাচন :

২০১৮ সালে টিএমসি, কংগ্রেসসহ বিরোধীদের ঘর ভাঙিয়ে রীতিমত মহীরুহে পরিনত। অন্যান্য বিরোধী দলের থেকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ক্ষতির পরিমাণ সর্বাপেক্ষা বেশি। কোথাও ভয় দেখিয়ে, কোথাও বলপূর্বক তো কোথাও অন্যান্য প্রলোভনের মাধ্যমে কংগ্রেসসহ বিরোধীদের দল ভাঙানোর যে খেলা টিএমসি শুরু করেছে, তার কারণে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা আজ বিরোধীশুন্য। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চায়েত নির্বাচনে, ক্ষমতায় থাকার কারণে ও সংখ্যাগুরু হওয়ার সুবাদে তৃণমূল দল ভোটে ব্যাপক সন্ত্রাস, ইভিএম কারচুপি এবং চূড়ান্ত অনিয়ম করে গেছে প্রশাসনিক ক্ষমতা ও রাজ্য পুলিশকে কাজে লাগিয়ে, যা দেশীয় মিডিয়া এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাগুলির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বিরোধী দলগুলি, বিশেষ করে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) অভিযোগ করেছে যে টিএমসি কর্মীরা ভোটারদের ভয় দেখানোর জন্য এবং তাদের ভোট দিতে বাধা দেওয়ার জন্য রীতিমত সন্ত্রাসের ঢেউ চালিয়েছে। বুথ দখল, ভোটারদের ভয়ভীতি এবং বিরোধী প্রার্থীদের উপর হামলার খবর ব্যাপক ভাবে প্রচারিত হয়েছে। রাজ্য জুড়ে সংঘর্ষের ফলে বহু কংগ্রেস ও সিপিএম কর্মীর আহত ও মৃত্যুর যতগুলি ঘটনা ঘটেছে তা সংবাদপত্র ও মিডিয়ার কল্যাণে আপনারা সকলেই অবহিত। ভোটপূর্ব, নির্বাচন চলাকালীন ও ভোটপরবর্তী সন্ত্রাস নিয়ে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল সংসদেও গলা চড়িয়েছেন। কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট করার নির্দেশ দিয়েছেন মহামান্য আদালত। কিন্তু রাজ্যের শাসক দলের সন্ত্রাস কমে নি। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে বহু কেন্দ্রে বিরোধীরা প্রার্থী পর্যন্ত দিতে পারে নি। যার ফলে, অনেক কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনের আগেই নির্বাচিত হয়ে বসেন, যা গণতন্ত্রে অভাবনীয়। বহু কর্মী, সমর্থক মারা গেছেন, বহু লোক আজও ঘরছাড়া। তাই, ২০১৮ সালে তৃণমূল অধিকাংশ গ্রাম পঞ্চায়েতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। বিরোধীদের প্রতিনিধিত্ব সেখানে হাতে গোনা। পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ জেলা বিশেষ করে বীরভুম, পশ্চিম মেদিনীপুর, উত্তর ২৪ পরগনা, হাওড়া ও উত্তরবঙ্গের বেশ কিছু জেলাগুলিতে ব্যাপক সন্ত্রাসের কারণে পঞ্চায়েত সংলগ্ন এলাকাবাসীরা ভোটদান কেন্দ্রে পর্যন্ত পৌঁছতে পারেন নি। ব্যাপক ছাপ্পা ভোট দিয়ে তৃণমূল অধিকাংশ পঞ্চায়েত নিজেদের দখলে রাখতে সক্ষম হয়। যে সব সমর্থক সমস্ত বাধা অতিক্রম করে ভোটদান কেন্দ্রে পৌঁছন, তাদের বাধা দেওয়ার জন্য টিএমসি কর্মীরা ভোটকেন্দ্রে হামলা চালায়। বিরোধী প্রার্থীদের এজেন্ট বসতে দেওয়া হয় নি শতকরা ৯৫ ভাগ ভোটদান কেন্দ্রেই। আবার ভোটের আগে প্রার্থীকে হুমকি দেওয়া হয়েছে, পরিবারের উপর অত্যাচার করা হয়েছে বা জোর করে মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হয়েছে এমন অসংখ্য খবর প্রকাশিত হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনী প্রক্রিয়ার নীতিকে যথারীতি ক্ষুন্ন করে। বিরোধীদের ঠুঁটো জগন্নাথ করে তৃণমূল অবাধে ব্যাপক রিগিং এবং সন্ত্রাস চালিয়ে গেছে। গণতন্ত্রকে নির্লজ্জভাবে হত্যা করা হয়েছে। ভোটের নামে প্রহসন হয়েছে।

৪) ২০১৬ এবং ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচন:

২০১৬ সালে ও ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত বিধানসভা নির্বাচনগুলিতেও যথারীতি টিএমসি দ্বারা কৃত সন্ত্রাস এবং ভীতি প্রদর্শনের প্রচুর রিপোর্ট পাওয়া যায় । বিরোধী দলগুলি, বিশেষ করে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, টিএমসির বিরুদ্ধে ভোটে বিরোধীদের প্রভাবকে দমন করতে এবং বলপূর্বক নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় হেরফের করতে নির্লজ্জ কৌশল ব্যবহার করার বারবার অভিযোগ করেছে। বুথ দখল, ভোটারদের ভয় দেখানো এবং বিরোধী প্রার্থীদের ওপর হামলার অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। বেশ কয়েকটি জেলায় প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংঘর্ষে আহত হওয়া ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। ২০২১ সালের ভোটে সিতলকুচির ঘটনা, যেখানে টিএমসি এবং বিজেপি সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের কারণে চারজন নিহত হয়েছিল, তা সারা দেশের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। এই ঘটনাটি নির্বাচনী উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তোলে এবং হিংসা ছড়ানোর ক্ষেত্রে চক্রাকারে নেতৃত্ব দেয়, যা ভোটকর্মী, ভোটার এবং প্রার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়ে গুরুতর উদ্বেগ সৃষ্টি করে।

৫) ২০২৩ এর আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচন :

আগামী ৮ই জুলাই পশ্চিমবঙ্গে আবার পঞ্চায়েত নির্বাচন। এবার এক অদ্ভুতুড়ে ঘটনার সাক্ষী হল বঙ্গবাসী। মহামহিম রাজ্যপাল আনুষ্ঠানিক ভাবে নির্বাচন কমিশনারের নামে সীলমোহর দেওয়ার আগেই তড়িঘড়ি স্বঘোষিত ( বলতে বাধ্য হচ্ছি ) শাসক দলের বশংবদ নির্বাচন কমিশনার পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করে দিলেন। যথারীতি শাসক দল প্রার্থীর নাম ঘোষণা থেকে শুরু করে দেওয়াল লিখন পর্যন্ত আরম্ভ করে দিল। মহামান্য আদালতের নির্দেশে কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতিতে পরিশেষে পূর্ব ঘোষিত দিনেই নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। মনোনয়ন দাখিল করার পর্যাপ্ত সময় না পাওয়ায় অধিকাংশ বিরোধী দলই সমস্ত পঞ্চায়েতে প্রার্থী দিতে পারে নি। আবার, অতিরিক্ত তাড়াতাড়ি করার কারণে অনেকের মনোনয়ন বাতিলও হয়ে গেছে। তারপর, বলপূর্বক ও ভয় দেখিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহারের ঘটনা তো আছেই। সেই মারাত্মক সন্ত্রাস এখনও চলছে। চতুর্দিকে বিরোধী বিশেষ করে কংগ্রেস প্রার্থী ও সমর্থকদের উপর ব্যাপক বোমাবাজি ও গুলি চালানোর খবর পাওয়া যাচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী ও যুবরাজ যতই আশ্বাস দিন না কেন, নির্বাচন যে শান্তিপূর্ণ বা অবাধ হবে না তা বলাই বাহুল্য। সর্বশেষ খবর যা পাওয়া গেছে তাতে গতকালও মুর্শিদাবাদের সামসেরগঞ্জে কংগ্রেস কর্মী আরিফ শেখকে গুলি চালিয়ে আহত করা হয়েছে। বেছে বেছে কংগ্রেস কর্মীদের টার্গেট করা হচ্ছে। মনোবল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। এর যোগ্য জবাব ভোটবাক্সে মানুষই দেবেন। গণতন্ত্রের উপর প্রভাব:তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় হিংসা ও সন্ত্রাসের পুনরাবৃত্তির ঘটনা রাজ্যের গণতান্ত্রিক কাঠামোর উপর ভীষণ ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। কংগ্রেসসহ বিরোধী দলগুলিকে দমন করার হাতিয়ার হিসেবে বার বার সন্ত্রাসের রাজনীতির ব্যবহার এবং ভোটারদের জোর করে ভোটদানে বিরত করা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের নীতিকে যারপরনাই ক্ষুণ্ন করে। এর ফলে কি হয়, প্রতিশোধের ভয়ে নাগরিকরা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে নিরুৎসাহিত বোধ করেন যার ফলে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ভিত্তির ক্ষয় হয়।অধিকন্তু, পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় সংঘটিত সন্ত্রাস বা হিংসা, আইনের শাসনের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এতে অত্যাচার ও অনাচারের পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং যেকোনো ব্যক্তি এবং গোষ্ঠী পরিণতির ভয়ের কারণে দায়বদ্ধতার সাথে কাজ করতে পারে না। এই ধরনের ঘটনা অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে এবং সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের বাধা দেয়, যা রাজ্যের সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে প্রভাবিত করে।উপসংহার:যেহেতু আমার এই লেখাটি শুধুই পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে সীমাবদ্ধ তাই আমি সেই প্রেক্ষিতে শাসকদলের অনবরত সন্ত্রাস ও হিংসার রাজনীতির উল্লেখ করলাম। পঞ্চায়েত নির্বাচনগুলি বারবার তৃণমূলী সহিংসতার দ্বারা অপূরণীয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, টিএমসির বিরুদ্ধে প্রায়ই বিরোধী দলগুলিকে দমন করার জন্য প্রশাসনের ও রাজ্য পুলিশের সহায়তায় নির্লজ্জ ছল, বল ও কৌশল ব্যবহার করার অভিযোগ আনা হয়েছে। উপরে আলোচিত ঘটনাগুলি ( বিশদে লেখার উপায় থাকলে রীতিমত দিনক্ষণ উল্লেখ করে সন্ত্রাসের উদাহরণ দেওয়া যেত, নীচের গ্রাফিকে আজকের আনন্দ বাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এবারের সন্ত্রাসের কিছু উদাহরণ আছে ) সামান্য কয়েকটি উদাহরণ যা রাজ্যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার চ্যালেঞ্জগুলিকে তুলে ধরে। ভোটার, বিরোধী প্রার্থী এবং নির্বাচনী কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ক্ষমতাসীন রাজ্য সরকারের বা কর্তৃপক্ষের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ( যা থাকে তারা সম্পূর্ণ বিচ্যুত), যাতে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি হয়। বাস্তবে যার অভাব হামেশাই চোখে পরে। কারণ, বর্তমান রাজ্য সরকার তা চান না। সাধারণ মানুষ তাই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে এক প্রকার ভয়ই পান। কোন পিতামাতা না চায় তাঁর সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে, অহেতুক সন্ত্রাসের কবলে পড়ার রিস্ক কেউ কেনই বা নেবে? নির্বাচনী সন্ত্রাস বা হিংসা মোকাবিলা করার জন্য রাজনৈতিক দল, আইনপ্রনয়নকারী সংস্থা এবং সুশীল সমাজসহ সকল স্টেকহোল্ডারের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার জন্য পর্যাপ্ত নিরপেক্ষ নিরাপত্তা কর্মী মোতায়েন, আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং রাজনৈতিক সহনশীলতার সংস্কৃতি গড়ে তোলার মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। যেখানে দলগুলি একে অপরের প্রচার এবং তাদের মতামত প্রকাশের অধিকারকে সম্মান করবে, যা সুস্থ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য অপরিহার্য। রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ এবং নাগরিকদের সম্মিলিতভাবে একটি পরিবেশ তৈরি করতে কাজ করা উচিত যেখানে নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও স্বচ্ছভাবে অনুষ্ঠিত হয় এবং মানুষের ইচ্ছাকে সম্মান করা হয়।পরিশেষে, স্বচ্ছতা, অন্তর্ভুক্তি এবং আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধার মত গণতান্ত্রিক আদর্শগুলিকে মাথায় রেখে রাজ্য সরকারের, পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন পরিচালনার নির্দেশনা দেওয়া উচিত, যা সংশ্লিষ্ট রাজ্য এবং নাগরিকদের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যত নিশ্চিত করবে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় সন্ত্রাসের সমস্যা মোকাবিলা করার মাধ্যমে, পশ্চিমবঙ্গ একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ভিত্তির দিকে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালাতে পারে, একটি সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে পারে যা তার নাগরিকদের প্রকৃত আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করতে সাহায্য করবে।

ছবি:(সংহতি কোলাম)

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *