শান্তনু দত্ত চৌধুরী
শতাব্দী প্রাচীন গোরক্ষপুরের গীতা প্রেস, যারা মহাত্মা গান্ধিকে হত্যা করার পর কোনও নিন্দা না করে নীরবতা অবলম্বন করেছিল, তাদের মোদি সরকার, ২০২১ সালের গান্ধি শান্তি পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের পক্ষ থেকে প্রেস বিবৃতিতে জানানো হয়েছে এক বিচারকমন্ডলী যার শীর্ষে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি , তাঁরা এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। বলা হয়েছে , অহিংস ও অন্যান্য গান্ধিবাদী পদ্ধতিতে সামাজিক , রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিবর্তনের ক্ষেত্রে যে অসামান্য অবদান গোরক্ষপুরের গীতা প্রেস শতবর্ষ যাবৎ স্থাপন করে এসেছে তার স্বীকৃতি স্বরূপ বিচারকমন্ডলী এই পুরস্কার প্রদান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।
গীতা প্রেসের প্রতিষ্ঠাতাদের সঙ্গে ও এদের পত্রিকা ‘ কল্যাণ ‘ এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হনুমান প্রসাদ পোদ্দারের সঙ্গে মহাত্মা গান্ধির পরিচয় ছিল। কিন্তু ‘ দলিতদের প্রতি অস্পৃশ্যতা ‘ নিয়ে তাঁদের মধ্যে মতপার্থক্য হয়। এরা হিন্দু মন্দিরে দলিতদের প্রবেশ অধিকার দেওয়ার বিরোধী ছিল।এই হনুমান প্রসাদ পোদ্দার ও গীতা প্রেসের প্রতিষ্ঠাতা জয়দয়াল গোয়েঙ্কা ১৯৪৮ সালে মহাত্মা গান্ধির হত্যাকাণ্ডের পর অন্য অনেকের সঙ্গে গ্রেপ্তার হন।
‘গীতা প্রেস অ্যান্ড দি মেকিং অফ হিন্দু ইন্ডিয়া ‘ গ্রন্থে অক্ষয় মুকুল লিখেছেন ১৯২৬ সালে হনুমান পোদ্দার তাঁর ‘ কল্যাণ ‘ পত্রিকার জন্য আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে স্বাধীনতা সংগ্রামী যমুনালাল বাজাজের সঙ্গে গান্ধিজির সঙ্গে দেখা করতে যান।গান্ধিজি তাঁকে বলেছিলেন, কখনও তোমার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন নিওনা ও পত্রিকায় কখনও পুস্তক পর্যালোচনা কোরোনা। এই উপদেশ শ্রীপোদ্দার গ্রহণ করেছিলেন।
কিন্তু পরবর্তী সময়ে হরিজনদের মন্দিরে প্রবেশ অধিকার ও পুনা প্যাক্ট সহ ‘বর্ণাশ্রম ও সাম্প্রদায়িকতা ‘ সম্পর্কিত বিষয়ে গীতা প্রেসের সঙ্গে গান্ধিজির গুরুতর মত পার্থক্য হয়। ‘ অস্পৃশ্যতা ‘ বিষয়ে শ্রী পোদ্দারের মত – পরিবর্তনের জন্য গান্ধিজির সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়।গান্ধিজির সঙ্গে তাঁদের এই বিতর্ক ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত চলে।
গান্ধিজির হত্যাকাণ্ডের পর শ্রীপোদ্দার ও শ্রী গোয়েঙ্কাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। শিল্পপতি ঘনশ্যামদাস বিড়লা এদের দুজনকে কোনরকম সহায়তা করতে অস্বীকার করেন।শুধু তাই নয় যখন শিল্পপতি স্যার বদ্রিদাস গোয়েঙ্কা এদের সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন, তখন ঘনশ্যামদাস বিড়লা ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন এরা ‘ সনাতন ধর্ম ‘ প্রচার করছিল না , এরা ‘ শয়তান ধর্ম ‘ প্রচার করছিল। মহাত্মার হত্যাকাণ্ডের পর ‘ গীতা প্রেস ‘ অখন্ড ‘ নীরবতা অবলম্বন করে। মহাত্মা গান্ধি, যাঁর আশীর্বাদ নিয়ে গীতা প্রেসের যাত্রা শুরু তারা ১৯৪৮ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত নিশ্চুপ থাকে। এরপর ওই হনুমান প্রসাদ পোদ্দার গান্ধিজির সঙ্গে তাঁর বিভিন্ন বিষয়ে যে মত বিনিময় হয়েছিল সে সম্পর্কে বিভিন্ন নিবন্ধ লেখেন।
উপরোক্ত বইটির উপসংহারে লেখা হয় “গীতা প্রেস বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার জন্য নিরলসভাবে কাজ করছিল। হিন্দুত্ববাদী মৌলবাদের জাগরণে গীতা প্রেস ও কল্যাণ পত্রিকা ভালো খেলোয়াড় ছিল। ১৯২৩ সাল থেকেই তারা হিন্দু মহাসভা , আর.এস.এস , জনসংঘ ও বি.জে.পি ‘ র সঙ্গে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে যোগাযোগ রেখে চলেছে এবং গুরুতর সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সময় ‘ কল্যাণ ‘ সর্বদাই এক ধর্ম বিষয়ক পত্রিকার শান্ত সংযমী ভূমিকা ত্যাগ করে ঘৃণা ও বিদ্বেষ প্রচারের মুখপত্রে পরিণত হয়েছে।
গত ১৮ জুন কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রক তাদের বিবৃতিতে বলেছে , ” প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মহাত্মা গান্ধি প্রদর্শিত পথে শান্তি ও সামাজিক ঐক্য গড়ে তোলার কাজে গীতা প্রেসের অবদানের কথা স্মরণ করেন।তিনি বলেছেন এই সংস্থার শতবর্ষে তাদের কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তাদের ‘ গান্ধি শান্তি পুরস্কার ‘ প্রদান সঠিক সিদ্ধান্ত।”
সংস্কৃতি মন্ত্রক ইতিপূর্বে ২০১৫ ও ২০১৭ সালে আর.এস.এস প্রভাবিত ‘ বিবেকানন্দ কেন্দ্র ‘ ও ‘ একাল অভিযান ট্রাস্ট ‘ কে এই গান্ধি শান্তি পুরস্কার প্রদান করে। এই পুরস্কারের অর্থমূল্য এক কোটি টাকা। মহাত্মা গান্ধির দর্শন ও আদর্শ বিরোধী সংগঠন গুলিকে ক্রমান্বয়ে গান্ধি শান্তি পুরস্কার দেওয়া এবং মহাত্মা গান্ধির স্মৃতিধন্য প্রতিষ্ঠানগুলি দখল করে হিন্দুত্ববাদি সংগঠনের হাতে তুলে দেওয়াই এখন নরেন্দ্র মোদির অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।