শহীদ এ আজম ভগৎ সিং

শান্তনু দত্তচৌধুরী

২৮ সেপ্টেম্বর। ১৯০৭ সালের এই দিনে যুক্ত পাঞ্জাবের লায়ালপুর জেলার বাঙ্গা গ্রামে তাঁর জন্ম হয়।
১৯৩১ সালের ২৩ মার্চ শহীদ এ আজম ভগৎ সিং তাঁর দুই সহ– যোদ্ধা রাজগুরু ও শুকদেব এর সঙ্গে লাহোর সেন্ট্রাল জেলে ফাঁসির মঞ্চে আত্মবলিদান করেন। তাঁদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
১৯২৯ সালের ৮ এপ্রিল ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত দিল্লির সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ এসেম্বলীতে অধিবেশন চলার সময় বোমা নিক্ষেপ করেন।তাঁরা ‘ ইনকিলাব জিন্দাবাদ ‘ ধ্বনি দিয়ে এই আক্রমণ পরিচালনা করেন।নিক্ষিপ্ত বোমায় কেউ মারা যায়নি।কাউকে মারাও তাঁদের উদ্দেশ্য ছিলনা।একটি শ্রম বিরোধী বিলের ওপর আলোচনা চলছিল।তাঁরা প্রতিবাদ ও দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই ওই বোমা নিক্ষেপ করেন।

এই ঘটনার বিচারে তাঁদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।কিন্তু ভগৎ সিং-এর কাছে প্রাপ্ত ‘রিভলভার’ ও ‘গুলি’থেকে পুলিশ বুঝতে পারে ভগৎ সিং জন স্যান্ডার্স-এর হত্যাকারী।ওই পুলিশ অফিসারকে হত্যা করার সময় এই রিভলভারটি ব্যবহৃত হয়েছিল।

১৯২৮ সালে সাইমন কমিশন বয়কট আন্দোলন চলার সময় পুলিসের লাঠির আঘাতে পাঞ্জাবকেশরী লালা লাজপৎ রাই মারাত্মক আহত হন ও পরে তাঁর মৃত্যু হয়।নিজেদের গুপ্ত সংগঠন হিন্দুস্তান সোসালিস্ট রিপাবলিকান আর্মি’র নির্দেশে ভগৎ সিং ,সহযোদ্ধা রাজগুরু ও শুকদেব ১৯২৮ এর ১৭ ডিসেম্বর লাহোরের এডিশনাল এস.পি জন স্যান্ডার্স কে হত্যা করেন। ইতিমধ্যে লাহোর ও সাহারানপুরে বিপ্লবীদের অস্ত্র ঘাঁটি পুলিশ চিহ্নিত করে ফেলে।অনেকে ধরা পড়েন।ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্তকে দিল্লি জেল থেকে পাঞ্জাবের মিআনওয়ালি জেলে নিয়ে আসা হয়।এই সময় ভগৎ সিং দেশের যুব সমাজের কাছে এক নায়কে পরিণত হন।জওহরলাল নেহরু তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন : “ভগৎ সিং শুধু গুপ্ত সন্ত্রাসবাদের পথ গ্রহণ করেছিলেন বলে জনপ্রিয় হননি,তিনি জনপ্রিয় হয়েছিলেন মহান নেতা লাল লাজপৎ রাই এবং সমগ্র জাতির সম্মান রক্ষার জন্য উদ্যোগী হওয়ায়।ভগৎ সিং সমগ্র জাতির কাছে এক প্রতীকে পরিণত হয়েছিলেন ,কী পথ তিনি গ্রহণ করেছিলেন তা বিস্মৃত হয়, কিন্তু প্রতীক অমর হয়ে থাকল।কয়েক মাসের মধ্যেই পাঞ্জাবের প্রতিটি গ্রাম ও শহর এমনকী উত্তর ভারতের গ্রামেগঞ্জে তাঁর নাম উচ্চারিত হতে থাকল।তাঁকে নিয়ে রচিত হলো অসংখ্য দেশাত্মবোধক গান।যে জনপ্রিয়তা তিনি অর্জন করলেন তা বিস্ময়কর”।

মিয়ানওয়ালি জেলে ভগৎ সিং রাজবন্দীদের সঙ্গে সম্মানজনক ব্যবহার, সংবাদপত্র ও বই পড়ার অধিকার, ইউরোপিয়ান বন্দীদের মতন একইরকম সুযোগসুবিধা ব্যবহারের দাবিতে অনশন শুরু করেন।স্যান্ডার্স হত্যার বিচারের জন্য তাঁকে ও শ্রীদত্তকে এইসময় লাহোর জেলে স্থানান্তরিত করা হয়।ওই জেলের রাজবন্দীরাও অনশন ধর্মঘট করছিলেন।তাঁদের ওজন ভীষণভাবে হ্রাস পায়। জওহরলাল জেলে গিয়ে অনশনরত বন্দীদের সঙ্গে দেখা করেন।তিনি তাঁর বিবৃতিতে বলেন:

“এই নায়কদের কষ্ট দেখে আমি যন্ত্রনা পেয়েছি।তাঁরা রাজবন্দীদের প্রতি রাজবন্দীর মতন ব্যবহার চান।তাঁদের আত্মত্যাগ অচিরেই সাফল্যের মুকুট অর্জন করবে।”

কিন্ত অনশনরত যতীন্দ্রনাথ দাসের অবস্থার খুবই অবনতি হয়।১৯২৯ এর ১৩ সেপ্টেম্বর তাঁর জীবনাবসান হয়।সারা দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়।প্রতিবাদে গোপিচাঁদ ভার্গব ও মহম্মদ আলম পাঞ্জাব বিধানসভা থেকে পদত্যাগ করেন।পন্ডিত মতিলাল নেহরু সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ এসেমব্লিতে সরকারের ভূমিকার তীব্র নিন্দা করে মুলতুবি প্রস্তাব পাশ করান।যতীন্দ্রনাথের নশ্বর দেহ হাওড়া স্টেশনে নিয়ে আসা হলে বিশাল শোকমিছিল কেওড়াতলা শ্মশানে শবানুগমন করে।নেতাজি সুভাষচন্দ্র ও দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন শোকমিছিলে নেতৃত্ব দেন।জওহরলাল তাঁর বিবৃতিতে বলেন:– “Another name has been added to the long and splendid role of the Indian Martyrs.Let us bow our heads and pray for strength to act to carry on the struggle,however long it may be and whatever consequences,till the victory is ours”.কংগ্রেস দল থেকে অনশন প্রত্যাহারের জন্য বিপ্লবীদের কাছে আবেদন জানানোর পর ভগৎ সিংহ তাঁর ১১২ দিনের অনশন প্রত্যাহার করেন।

এরপরই দ্রুত বিচার সম্পন্ন করে ভগৎ সিং ,রাজগুরু ও শুকদেবের প্রানদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।অন্য ১২ জন বিপ্লবীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।১৯৩১ সালের ২৩ মার্চ লাহোর জেলে তিন বিপ্লবীর ফাঁসি হয়।মহাত্মা গান্ধী তাঁদের প্রাণদণ্ড রদ করবার চেষ্টা করেন , কিন্তু ব্যর্থ হন।এরপরই ১৯৩১ এর মার্চে করাচিতে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস অধিবেশনে তাঁকে বিক্ষোভের সম্মুখীন হতে হয়।গান্ধিজি ১৯৩১ এর ২৯ মার্চ তারিখে ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকাতে ভগৎ সিং ও তাঁর সহযোদ্ধাদের ‘জাতীয় বীর’ বলে উল্লেখ করেন।তিনি লেখেন “তাঁদের প্রাণদণ্ড রদ করার জন্য আমাদের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে।ভগৎ সিং রাষ্ট্রীয় হিংসার কাছে আত্মসমর্পণ করেননি।তিনি অহিংসায় বিশ্বাসী ছিলেননা, কিন্তু অসহায়তার জন্যই তিনি বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক পথ গ্রহণ করেছিলেন”। গান্ধিজি ইংরেজ সরকারের সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা করে লেখেন “এই বীরদের মুক্তির জন্য জাতির সর্বসম্মত প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে ইংরেজ সরকার এই দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের সম্ভাবনাকেও বিনষ্ট করেছে”।

সুভাষচন্দ্র বলেন “ভগৎ সিং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এক নবজাগরণের স্রষ্টা ,এক অগ্নিস্ফুলিংগ”।করাচি কংগ্রেস অধিবেশনে ভগৎ সিং,রাজগুরু ও শুকদেবের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য শোকপ্রস্তাব রচনা ও উত্থাপন করেন জওহরলাল।এই সময় বিপুল সংখ্যক প্রতিনিধি উচ্চস্বরে ক্রন্দন করতে থাকেন।অনেককে নীরবে চোখের জল ফেলতে দেখা যায়।প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।এই অধিবেশনে ভগৎ সিং-এর পিতা সর্দার কিষান সিং উপস্থিত ছিলেন।তিনি তাঁর প্রেরণাদায়ক ভাষণে বলেন ” শেষ লড়াই এবার শুরু হবে।তাঁর ছেলে তাঁকে বলে গিয়েছে জাতির সেনাধ্যক্ষ গান্ধিজির নেতৃত্বে এই সংগ্রামে যেন সবাই যোগ দেয়।” ভগৎ সিং ও সহ বিপ্লবীদের সমর্থনে ওই সময়ে আর এস এস ও হিন্দু মহাসভার কোনো নেতা কোনো বিবৃতি দেননি। এই শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে এরা কোনো প্রস্তাবও গ্রহণ করেননি।প্রকৃতপক্ষে এই দুই সংগঠন কোনোদিন দেশের স্বাধীনতাও দাবি করেনি।এখন এই দুই সংগঠনের অনুচররা সশস্ত্র বিপ্লবীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের নামে মহাত্মা গান্ধি, পন্ডিত নেহরু ও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচার চালাচ্ছে।এদের আই. টি সেল-এ নির্মিত Fake History’ র সংবাদ প্রচার করে চলেছে ।ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনও এদের আক্রমণের লক্ষ্য।

১৯২৫ সালে জন্মের পর থেকে আর এস এস ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী কোনো সংগ্রামে যোগ দেয়নি।মুস্লিম লিগের মতন এরাও ছিল ব্রিটিশের স্তাবক।এখন এরা সর্দার প্যাটেল, নেতাজি সুভাষচন্দ্র ও বিপ্লবী দের সামনে রেখে এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচার চালাচ্ছে।কারণ এদের কোনো নেতা কখনো একদিনের জন্যও কারাবাস করেনি।অত্যন্ত দুঃখের বিষয় কিছু অতি বাম যুবক দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে কোনো অধ্যয়ন না করে আরএসএস -এর গান্ধিজি বিরোধী প্রচারকেই শক্তিশালী করছে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *