বিজেপির অনুপ্রেরন নাৎসীদের অনুকরণ করেই *কেরালা স্টোরি*

অমিতাভ সিংহ

কেরালা স্টোরি,বজরংবলী থেকে বিভাজনের সমস্ত অস্ত্র এক এক করে প্রয়োগ করা হল কর্নাটকের নির্বাচনের প্রচারে।এমনকি প্রচার শেষ হয়ে যাওয়া পরেও মোদীর বিজেপিকে ভোট দেওয়ার ভিডিও বার্তা প্রচারিত হল। নির্বাচন কমিশন যথারীতি সুখনিদ্রায়।এতকিছুর পরেও মুখ থুবড়ে পরল বিজেপি এই রাজ্যে। আজকের আলোচনা সিনেমাটিকে নিয়ে তাই নির্বাচনের দিক থেকে নজর ঘুরিয়ে আসল প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক।কর্নাটকের বল্লারী নির্বাচনীকেন্দ্রের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দুহাত তুলে নৃত্য করতে করতে একটি বিশেষ হিন্দী সিনেমার প্রচার করতে দেখে প্রথমবার আগ্রহী হয়ে *কেরল স্টোরি* দেখি।আদ্যপান্ত মিথ্যার বেসাতি, অতি দূর্বল চিত্রনাট্য,জঘন্য পরিচালনা তদোপরি বিশ্রী অভিনয়।কতই বা বলবো এই সিনেমাটি সম্পর্কে।এটি কি করে কয়েকদিনে এত টাকার ব্যাবসা করল তা ভাবতেই আশ্চর্য লাগছে। স্বাধীনতার পর নেহেরু শাস্ত্রী,ইন্দিরা,রাজীব,মনমেহনেরাহাজার চেষ্টা করেও যে দেশবাসীকে এখনও ততটা শিক্ষিত করতে পারেন নি,অথবা নিছক ধর্মের সুড়সুড়ি বা মুসলীম বিদ্বেষী মিথ্যা প্রচার থেকে নিজ বুদ্ধি বৃত্তি প্রয়েগে দূর্বলতা আর কত বছর আমাদের মননে তীব্রভাবে আসন পেতে বসবাস করবে কে জানে? গোয়েবলসীয় মিথ্যা প্রচারের সঙ্গে এই সিনেমাটির মিল কতটা তা নিয়ে পরে আলোচনা করছি।এই ফিল্মটিতে বলা হয়েছে সত্যএ ঘটনা থেকে অনুপ্রানিত হয়ে এটা নির্মিত।বলা হয়েছে ধামাচাপা দেওয়ার সত্য উদ্ঘাটন।কিন্তু কোথায় কি? পোষ্ট ট্রুথ অর্থাৎ মূল সত্যকে খারিজ করে নিজের মনগড়া মতামত বা কল্পনাপ্রসূত একটা গল্প নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে কোন কাজ করা,যা এখানে কাশ্মীর স্টোরির থেকেও মোটা দাগের।পুরো ফিল্মটিতে যুক্তির অভাব,প্রথম থেকেই অভিনেত্রীদের চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ,ফাঁকফোকরে ভর্তি।পরিচালক সুদীপ্ত সেনের যে নূন্যতম পড়াশোনা নেই তা স্পষ্ট প্রতিটি দৃশ্যে।এনডিটিভির মতে ধারাবাহিকভাবে ভীতিসঞ্চার করেছে এই ফিল্মটি। স্ক্রল বলেছে ইসলামোফোবিয়া,ইন্ডিয়া টুডের মতে ফিল্মটি নিম্নস্তরের লেখা ও খারাপ পরিচালনা,ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস নিম্নস্তরের অভিনয় আর প্রিন্ট লিখেছে হাস্যকরভাবে অতিরন্জিত প্রচার।ফিল্মটি পরিচালনা করেছেন ও চিত্রনাট্য লিখেছেন সুদীপ্ত সেন( সারদা মামলার আসামী নয়),প্রযোজনা ও ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর বিপুল অমৃতলাল সিং।ফিল্মটিতে দেখানো হয়েছে শালিনী উন্নিকৃষ্ণন নামে এক হিন্দু যুবতী নার্সিং পড়তে আসে মুসলীম নার্সিং কলেজে।হোস্টেলে তার সঙ্গে একই ঘরে থাকে আরও তিনজন।গীতান্জলী,যার পিতা কমিউনিস্ট। নইমা,খ্রিষ্টান পরিবারের মেয়ে।তৃতীয়জন আসিফা, যে আইএসআইএসের এজেন্ট,যে কিনা অন্য ধর্মের মেয়েদের ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করে সিরিয়া,ইয়েমেন,আফগানিস্তানের মত দেশে যৌনদাসী হিসাবে পাচারের সঙ্গে যুক্ত।এরপর অতি হাস্যকরভাবে তিনজন আসিফার ফাঁদে পড়ে ও ভয়ঙ্কর ইসলামী নিষ্ঠুরতার শিকার হতে হয়।এই নিয়েই গল্প।এই ফিল্মটির ট্রেলরে বলা হয়েছিল ৩২,০০০ মহিলা কেরল থেকে নিখোঁজ,যা সবৈব মিথ্যা ও জালিয়াতি। গুজরাটে ন্যাশানাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো( এনসিআরবি) অনুযায়ী পাঁচ বছরে ৪০ হাজারেরও বেশী নারী নিখোঁজ, কই তা নিয় তো পরিচালক কোন কথা বলেন নি।৩২,০০০ নিখোঁজ সম্পর্কে পরিচালক বললেন এর প্রমান আছে।আদালতে তা দিতে না পেরে বত্রিশ হাজার সংখ্যাটি নেমে এল মাত্র তিনে।এরপরেও এই ধাপ্পাবাজদের সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার আছে? এরপর পরিচালক ট্রেলর থেকে তা সরিয়ে নিল,কিন্তু এরই মধ্যে যা প্রচার হওয়ার তা তো হয়ে গেছে।সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৬ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ২৫০০ এর মত বিভিন্ন ধর্মের মানুষ ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছেন প্রধানত মহারাষ্ট্র, তেলেঙ্গানা ও কর্নাটক থেকে।পৃথিবীর ১১০ টি দেশের মোর হাজার চল্লিশেক ধর্মান্তরিত হয়েছেন বলে ইউনাইটেড নেশনের রিপোর্ট। ইন্টারন্যাশনাল স্টাডি অব রাডিকালাইজেশন (ICSQ), কিংস কলেজ,লন্ডন অনুযায়ী ৮০ টি দেশের মোট ৪২,২১০ জন আইএস এর সঙ্গে যুক্ত ছিল।এর মধ্যে ৩২,৮০৯ জন পুরুষ, ৪,৭৬১ জন মহিলা ও ৪,৬৪০জন শিশু। ভারতের ১৮০ থেকে ২০০ জনের মত যুক্ত যার মধ্যে জনা চল্লিশ কেরলের। আরো একটা আন্তর্জাতিক রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম সংখ্যক মুসলীমদের বাস হওয়া সত্ত্বেও ভারত থেকে আইএস এ যোগদানের সংখ্যা অত্যন্ত কম।এক মিলিয়নে ০.৫%, যেখানে ফ্রান্সের হার ভারতের ৩৬ গুন বেশী।ভারত সরকারের কাছ থেকে আরটিআই করে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ১০০ থেকে ১২৫ জনের বেশী কখনই যোগ দেয় নি আইএস বাহিনীতে। কর্নাটকের নির্বাচনী প্রচারে এই ফিল্মটি যেভাবে দেশের প্রধানমন্ত্রী প্রচার করছিলেন তা দেখে চমকে গিয়েছিলাম।আরও অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যেভাবে এর সঙ্গে কংগ্রেসকে জুড়ে দেওয়ার নিকৃষ্ট চেষ্টা করেছিলেন।ভাবতে পারা যায় যে দলের অসংখ্য কর্মী নপতা শহীদ হয়েছেন দেশের স্বাধীনতা আনতে গিয়ে বা যে দলের সর্বোচ্চ নেতা গান্ধীজি ও দুই প্রধানমন্ত্রী শহীদ হয়েছেন দেশের অখন্ডতা রক্ষা করতে গিয়ে আজ তাদের দিকে আঙুল তুলছে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশ্বাসঘাতকের জারজ সন্তানেরা? তাই বোধহয় কর্নাটকের মানুষ এর বিরুদ্ধে মোদীর মুখে বেশ করে ঝামা ঘষে দিল্লী পাঠিয়ে দিয়েছেন।কিন্তু এই প্রচারকে হাল্কা করে দেখলে চলবে না।এর সঙ্গে জার্মানিতে নাৎসিবাহিনীর প্রচারের একটা মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কি? যেখানে নাৎসীদের ইহুদিদের বিরুদ্ধে বোঝানের মত ভারতে প্রতিটি হিন্দুকে ধারাবাহিকভাবে বোঝানো হচ্ছে তোমার সবচেয়ে বড় শত্রু হল পাশের বাড়ীর মুসলমানটি।সোস্যাল মিডিয়া থেকে চ্যানেলের ডিবেটে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা হচ্ছে আর মাত্র কয়েক বছর,তারপরই এই দেশ হয়ে যাবে মুসলীম অধ্যুষিত দেশ।মজার কথা হল বেশীরভাগ হিন্দু,এমনকি শিক্ষিত হিন্দুকুলও তা বিশ্বাস করে সেকুলারিজমকে ব্যঙ্গ করে পোষ্ট করছেন।প্রায় সাতশ বছর মোগল আমলে যখন এই দেশ ইসলামী দেশ হিসাবে পরিগণিত হয় নি সেক্ষেত্রে এখনও যে তা সম্ভব নয় এই সহজ সত্যটা তারা বুঝছে পারছেন না বা বুঝতে চাইছেন না তা গবেষনার বিষয়।এখনও তাদের ধারনা প্রতিটি মুসলমান চারটি করে বিয়ে করে ও অন্তত বৌপিছু চার পাঁচটা করে বাচ্চা তাদের ঘরে জন্মায়।আরে বাবা তা হলে তো সমাজে পুরুষ নারী এই অনুপাত যেখানে চলে যাবে তখন তাদের মধ্যেই তো খুনোখুনি লেগে যাবে।১৯৪০ সালে ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভালে জুড য়ুস নামে একটি জার্মান ফিল্ম দেখানো হয়।তখন জার্মানির জনসংখ্যা ছিল ৭০ মিলিয়ন,যার মধ্যে ২০ মিলিয়ন মানুষ অন্তত একবার উক্ত ফিল্মটি দেখেছিলেন।তৎকালীন বিশিষ্ট জার্মান পরিচালক ভিট হারলান ছিলেন পরিচালক হিটলারের প্রচার সচিব(প্রোপাগান্ডা মিনিস্টার) জোসেফ গোয়েবলসের নির্দেশে।এই ফিল্মটিতেও তিনটি চরিত্রঃ একজন ইহুদী মহাজন জোসেফ ওপেনহাইমার,একজন ডিউক অব উর্টেমবার্গ ও অপরজন জার্মান যুবতী ডরোথি স্টার্ম।ডিউককে ধার দিয়ে ইহুদী মহাজনটি ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে ফেলে দাড়ি কামিয়ে বেশভূষা পাল্টে খ্রিষ্টানের ছদ্মবেশে ডিউকের প্রাসাদে প্রবেশ করে ও ধূর্ততার সঙ্গে ঐ অঞ্চলে ইহুদিদের ওপর থেকে শতাব্দীপ্রাচীন নিষেধাজ্ঞাটি ডিউককে দিয়ে প্রত্যাহার করিয়ে নেন।এরপর ইহুদি মহাজন জোসেফ, ডরোথীকে ক্রমাগত যৌন প্রস্তাব দিতে থাকে ও ধর্ষণ করে। ডরোথী আত্মাহত্যা করে।এরপর জোসেফের আসল পরিচয় প্রকাশ হয় ও উত্তেজিত জনতা জোসেফকে চরমতম শাস্তি দেয় ও পুনরায় নিষেধাজ্ঞাটি পুনরায় বলবৎ হয়।এবার আসা যাক কেরালা স্টোরির আলোচনায়।গল্পটি আগেই বলেছি।আজকের ভারতে আরএসএস যেভাবে বিভিন্ন কাজের মধ্যে ও পরিকল্পিতভাবে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করতে চায় তাতে গোয়েবলসীয় কায়দায় প্রোপাগান্ডা অত্যন্ত জরুরি।গোয়েবলসীয় কায়দাটি হল একটি মিথ্যাকে বারবার যদি কারো কানে আওড়ানো যায় তাহলে একদিন সেই মিথ্যা লোকে সত্য বলে মেনে নেবে।এই আরএসএস ও তাদের রাজনৈতিক দল বিজেপি হিটলারের নাৎসীদের ঘোর সমর্থক।তাই তাদের কর্মপদ্ধতিও নাৎসীদের অনুসারী। নাৎসীদের প্রচার জার্মানিতে এমন হয়েছিল যে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে গোটা জার্মানিতে সমস্ত ইহুদি জাতিকে এক ঘৃণ্য বলে চিহ্নিত করে দিয়েছিল ও তাদের নিকেশ করার অধিকার রাষ্ট্র লাভ করেছিল যাতে জনতারও সমর্থন আছে।এই চরিত্রটি আজকের ভারতে ইনজেক্ট করার প্রবল চেষ্টা চলছে তীব্রভাবে।৮০ বছর পর বিশ্বের আধুনিক প্রযুক্তি অনেকটাই এগিয়েছে। সোস্যাল মিডিয়া,যেমন ফেসবুক,ইনস্টাগ্রাম,টুইটার তো আছেই।তার সঙ্গে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল ও ফিল্ম, যা একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসাবে স্বীকৃত।১৯৩৩ সালে হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর হওয়ার পর গোয়েবলস জার্মানির ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কতৃত্ব নিজের হাতে নিয় নেয়।প্রতিষ্ঠিত হয় রাইখ চেম্বার অব ফিল্মস।তৈরী হয় একের পর এক প্রচারমূলক ছবি।দেওয়া হয় ঢালাও অর্থ ও পুরষ্কার।নিরপেক্ষ ও বিরোধী পরিচালক ফ্রিৎস ল্যাং, বিলি ওয়াইন্ডাের মত পরিচালক ও সর্ববৃহৎ প্রযোজনা সংস্থা UFA এর প্রধান এরিক পোমারও দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।এদেশেও ২০১৯ সালে নির্মিত পিএম নরেন্দ্র মোদী ফিল্মটিও একই গোত্রে পড়ে।এখানে মোদীকে এক সিংহহৃদয় মসিহা হিসাবে তুলে ধরা হয়।মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়। অথচ চিন ভারতের ২০০০ বর্গ কিমি জায়গা দখল করা সত্ত্বেও মোদী চিনের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করতে ভয় পান।ঠিক একইভাবে ১৯৩৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত রেনি রিফেনস্টাহল পরিচালিত ট্রায়াম্ফ অফ দ্য উইল সিনেমাটিতে হিটলারকে লার্জার দ্যান লাইফ হিসাবে তুলে ধরেছিল। একইসঙ্গে চলছিল ইহুদী বিদ্বেষী ফিল্ম দ্য রথসচাইল্ডস,দ্য ইন্টারনাল জু ইত্যাদি। এইভাবে মানুষকে মধ্যে বিষ ঢাকার কাজটি চলত। দর্শকদের হৃদয়ে এই বিষ এক বিধ্বংসী ঘৃণা নিয়ে সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে এসে সমাজে আগুন জ্বালাত।যেমন আজ বিভিন্নভাবে বিজেপি নেতা মন্ত্রীরা এমনকি প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ঘৃণাভাষনের মাধ্যমে সংখ্যা লঘুদের সম্পর্কে ক্রমাগত বিষ ঢেলে যাচ্ছেন। করোনার সময় তবলিগি জামায়েতের সম্মেলনে লোকসমাবেশকে কিভাবে টার্গেট করে দিনের পর দিন ঐ সম্মেলনে যোগ দিতে আসা বিদেশী প্রতিনিধিদের জেলবন্দী করে রাখা হয় তা নিশ্চই ভুলে যাই নি।অথচ সেসময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে বিশাল মিছিল যে করোনা ছড়াবার অন্যতম কারন তা স্বীকার করা হয় নি।এমনকি মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস সরকার ভেঙে বিজেপি সরকার গঠন করার জন্য লকডাউন পেছিয়ে দেওয়া হয়।কাশ্মীর ফাইলস বা কেরালা স্টোরিও একই গোত্রের।জুড য়ুস সিনেমাটিতে যেমন জোসেফ চরিত্রটিকে একটা শঠ ও ষড়যন্ত্রকারী বলে গোটা ইহুদী জাতিটাকেই একই পঙতিতে ফেলে চিহৃিত করা হয়েছিল,তেমনি আসিফা নামক চরিত্রকে সামনে রেখে ইসলামকে একইভাবে তৈরী করা হয়েছে কেরালা স্টোরিকে।নিছক নরকের ভয় দেখিয়ে ও শিব তার স্ত্রীর মৃত্যুতে কাঁদে বা কৃষ্ণ লীলা করে এইবলে হাস্যকরভাবে আসিফা তিন তিনজন শিক্ষিত যুবতীকে ইসলাম ধর্ম গ্রহনে বাধ্য করল।কিন্তু এই হাস্যকর ব্যাপারটা প্রচারকারীদের জানা থাকলেও কিছুই এসে যায় না।কারন তারা জানে দর্শকেরা এতসব মাথায় রাখবে না,তারা তখন তাদের শত্রুকে চিনে নিতে বাধ্য হয়েছে বোধবুদ্ধি লোপ করে।এই প্রচার আগাগোড়া পুরুষতান্ত্রিক ও তাদের শীর্ষ নেতা একজন ফ্যাসিস্ত, সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একজন নারীকে জাতির পবিত্রতার মানদন্ড হিসাবে ধরতে হবে। দুটো সিনেমাতে কি একই মিল পাওয়া যাচ্ছে না।পুরো সিনেমায় মুসলমান পুরুষদের ভয়ঙ্করতা ও নারীদের অসহয়তা আমাদের মনে এক আতঙ্কের বাতাবরণ সৃষ্টি করে। অস্বস্তিকর সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স আমাদের শিহরিত করে প্রতিটি মূহুর্তে।এরকমই একটি দৃশ্যে মুসলমান স্বামী তার ধর্মান্তরিত অনিচ্ছুক স্ত্রীকে শাসায় যে স্বামীর ইচ্ছায় সহবাস করা স্ত্রীর কর্তব্য। এই বলে সে তার স্ত্রীকে জোর করে ধর্ষণ করে। আমাদের দেশে বিবাহত্তোর সহবাসকে ক্রিমিনাল অফেন্স তকমা দিতে এখনও ষথেষ্ট দোনোমনা আছে।কিন্তু এ যে মুসলমান,তাই একটা ৪৪০ ভোল্টের ধাক্কা লাগে।জার্মান সিনেমাটিতে ন্যারেটিভ স্থির হয় শয়তান ও নোংরা ইহুদী, পবিত্র জার্মান নারীদেহর দিকে ভুলেও তাকাবে না।একইভাবে কেরালা স্টোরিতে এইধরনের ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখানো হয়েছে।জার্মান সিনেমাগুলির মতই সুদীপ্ত সেনের সিনেমাটিতে কমিউনিস্টদের প্রতি আক্রমন করা হয়েছে।এই সিনেমাটিতে গীতান্জলী তার পিতার আদর্শকে বাতিল করে মহান হিন্দুত্বর ঐতিহ্যর সঙ্গে পরিচয় না করানোর জন্য তার কমিউনিস্ট পিতাকেই দায়ী করে।এগুলো নিছক কাকতলীয় হতে পারে না।সুদীপ্ত সেন নিশ্চয় নাৎসী জার্মানির গোয়েবলসীয় প্রচারধারার সিনেমাগুলি বার বার দেখেছেন ও অনুপ্রানিত হয়েছেন।সিনেমার কাস্টিং এ তার একটা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা দরকার ছিল না কি? আসলে এই নকলটা চাপা দেওয়ার একটা তাগিদ তো মোদীবাহিনীর আছেই। কেরালা স্টোরিতে খুব চালাকির সঙ্গে আন্তর্জাতিক প্লটটি ব্যবহার করা হয়েছে, ইসলামোফোবিয়া। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই তৈরী করা হয়েছে।এটাই সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি যা বক্স অফিসে ঝুলি ভরাবে আর শাসকদলের ন্যারাটিভের সঙ্গে মিলে নানারকম সুযোগসুবিধা দেবে যেমন বিভিন্ন রাজ্যে প্রমোদকরমুক্ত ও আরও কত কিছু।রাজ্যসভার সদস্যও হতে পারে।একটা অর্ধসত্য মিথ্যার আলোকে নির্মিত ফিকশন যে কতটা কার্যকরী হতে পারে তা গোয়েবলস আশি বছর আগেই বুঝতে পেরেছিলেন।সুদীপ্ত গত বছর একই বিষয়ে একটি ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলেন,ইন দ্য নেম অব লাভ। তারপরও এই ফিকশন তৈরী কি গোয়েবলসীয় ঘরনার প্রতি নিখাদ সমর্পন নয়? সেই উপলদ্ধি থেকেই হিন্দু জাগরণের ডাক প্রতিদিন প্রতিমূহুর্তে প্রতিটি বিজেপি- আরএসএস নিয়ন্ত্রিত সোস্যাল মিডিয়া গ্রুপে।কিন্তু কেন নিজেদের দেশের একটা রাজ্যের এত বদনাম করার চেষ্টা? কেরালায় হিন্দু, ইসলাম ও খ্রিষ্টান ধর্মর মোটামুটি সমান সংখ্যক মানুষ বসবাস করেন ও তারা মালয়ালি ভাষায় কথা বলে গর্ববোধ করেন।তারা দীর্ঘদিন সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি রক্ষা করে মিলেমিশে পাশাপাশি বসবাস করেন। তাদের আর্থ সামাজিক অবস্থাটিও দেশের বেশীরভাগ রাজ্যের চেয়ে অনেকটাই ভাল।স্বাক্ষরতার হার ৯৭%(দেশের হার যেখানে ৭৭%),কেন্দ্রিয় সরকার ও অন্যান্য রাজ্যের প্রসাশনে মালয়ালিভাষীরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেন। তাদের শিক্ষা,কঠোর পরিশ্রম ও মেধাই তাদের এতটা উচ্চস্তরে প্রতিষ্ঠিত করেছে।বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেসব মালয়ালিভাষী মানুষ চাকুরিসূত্রে রয়েছেন তারা দেশের ৩৬% বিদেশী মুদ্রা অর্জন করে।২০২০ সালে তারা দেশে ২৩৪,০০০ কোটি টাকা পাঠিয়েছেন। এই রাজ্যে মাথাপিছু আয় দেশের মাথাপিছু আয়ের চেয়ে ৬৬% বেশী।৯৪% মেয়ে দ্বাদশ শ্রেণীর বেশী পড়াশোনা করে( মোদীর গুজরাটে ২৯%)।জন্মের সময় শিশুমৃত্যুর হার এইরাজ্যে ১০০ এর মধ্যে ৬ জন,গুজরাটে তা ৪৬ জন।এরাজ্যে গড় আয়ু ৭৫ বছর,যেখানে ভাইব্রান্ট গুজরাটে ৭০.৫ বছর।মাতৃত্বকালীন মৃত্যুর হার এরাজ্যে ৩০%, গুজরাটে তা ৭০%। উচ্চশিক্ষার নথিভুক্তকরনের হার ৮৩%( গুজরাটে যা ৪৩%)।শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির হার ১৯%( গুজরাটে তা ৩৪%)।এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়।এই রাজ্যের পি টি উষা,অন্জু ববি জর্জ,সমবায় আন্দোলন ও দুগ্ধ বিপ্লবের জনক ডা: ভার্গিস কুরিয়েন,ডঃ শশী থারুর আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছেন।এহেন এই রাজ্যের মানুষেরা স্বাধীনতার পর হয় কংগ্রেস নতুবা কমিউনিস্টদের নির্বাচিত করেছেন।বিজেপির ঘৃণাভরা রাজনীতির পশ্চাতে পদাঘাত করে তাদের জন্জালের পাশে ফেলে দিয়েছেন।তাই তাদের এত রাগ এই রাজ্যের ওপর।তাবলে একজন প্রধানমন্ত্রী নিজে তার দেশের একটি রাজ্যের এতটা মিথ্যা বদনাম করবেন? এখন যদি কেউ এই প্রচার করেন যে এই দেশে বিমানে বরিষ্ঠ নাগরিক ও নারীদের শরীরে পুরুষেরা মদ্যপান করে প্রস্রাব করতে অভ্যস্ত তাহলে কি তাতে দেশের সম্মান বাড়বে? ২/৩ টি ঘটনাকে ৩২,০০০ বলে চালানোর চেষ্টাকে সেন্সর বোর্ড আটকালো না কেন? সুপ্রীম কোর্টকে কেন হস্তক্ষেপ করতে হল? আর সুপ্রীম কোর্টই বা কেন এই ঘৃণাভরা মিথ্যাশ্রয়ী সিনেমাটির ছাড়পত্র আটকালেন না কেন,এসব প্রশ্ন রেখেই সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে আক্রমন নতুন ভারতে চালানোর চেষ্টা হবে আর তা রুখতে হবে কংগ্রেস। কর্মীদেরই।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *