মহাত্মা গান্ধির বিচারধারার উপর দেশে ক্রমবর্ধমান আক্রমণ করে চলেছে আর এস এস ও বিজেপি

শুভাশিস মজুমদার

মহাত্মা গান্ধি প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী গুজরাট বিদ্যাপীঠের প্রশাসনের উপর গত বছর থেকে গুজরাট সরকারের হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা শুরু হয়। বিজেপির আসল উদ্দেশ্য হল মহাত্মা প্রতিষ্ঠিত সমস্ত সংগঠন দখল করা ও তাঁর আদর্শ ধ্বংস করা।

গত ৪ আগস্ট, জনৈক হিন্দি অধ্যাপক প্রথাগত প্রার্থনা সভা চলাকালীন, বিদ্যাপীঠের ছাত্রীদের সর্বধর্ম প্রার্থনা করতে বাধা দেন। শুধু তাই নয়, প্রকাশ্যে মেয়েদের অপমান করা হয়।

এই সময় সেখানে উপস্থিত এক অধ্যাপিকা হিন্দি অধ্যাপকের এমন লজ্জাজনক আচরণের প্রতিবাদ করেন। সর্বধর্ম প্রার্থনা বিদ্যাপীঠের ঐতিহ্য এবং সূচনাকাল থেকেই মূল্যবোধ ও আদর্শের অবিচ্ছিন্ন অংশ।

গত ৭ আগস্ট,সোমবার, বিদ্যাপীঠের ছাত্ররা সর্বধর্ম প্রার্থনা বন্ধ করার বিরুদ্ধে গান্ধিবাদী উপায়ে একটি কালো ফিতা বেঁধে প্রতিবাদ করেছেন।

সারা দেশে গান্ধিবাদী প্রতিষ্ঠানগুলিকে দখল করার সুপরিকল্পিত প্রকল্পটি কার্যকর করতে একটি মিশন প্রস্তুত হয়েছে বলে সংবাদে প্রকাশ। বারাণসীতে সর্বসেবা সংঘ আশ্রম দখল ও গত ১২ আগষ্ট তা ধ্বংস করা থেকে শুরু করে মহাত্মার দর্শনের বিরোধী গীতা প্রেসকে গান্ধী শান্তি পুরস্কার প্রদানের পরিকল্পনাটি অত্যন্ত সুচিন্তিত ভাবে করা হয়েছে। এই গীতা প্রেস গান্ধিজির হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ওই সময় প্রতিবাদে একটি কথাও বলে নি।

২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে, কেন্দ্রের শাসক (বিজেপি) দলের রাজনৈতিক পরীক্ষাগার, অর্থাৎ গুজরাট সরকারের কার্যকলাপ, ওই একই লক্ষ্যে পূর্ণ উদ্যমে চলছে। একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় দখল করার সময় নেই। সুতরাং, গুজরাট সরকার বিধানসভার আসন্ন বর্ষাকালীন অধিবেশনে একটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় বিল পেশ করতে প্রস্তুত। এই আইন সিনেট এবং সিন্ডিকেট নির্বাচন বন্ধ করে দেবে।

সরকার সরাসরি বোর্ড অব গভর্নেন্স নামে একটি নতুন কমিটিতে পছন্দমত সদস্যদের নিয়োগ করবে।

এটি গুজরাটের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ছাত্র সখগঠনের অবসান ঘটাবে। অর্থাৎ ছাত্রদের আর ছাত্র সংগঠন করার অধিকার থাকবে না। এর পাশাপাশি উপাচার্যের তিন বছরের মেয়াদ বাড়িয়ে পাঁচ বছর করা হবে।

ক্ষমতালোভী নেতারা সর্বদা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ছাত্র বিক্ষোভকে ভয় পান। অভিযোগ, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার ও আরএসএস, বিজেপি অনুগামীরা বেশ কয়েকবার এর প্রমাণ দিয়েছে , বিজেপি বিরোধী প্রতিবাদী ছাত্রদের উপর দমন – পীড়ন চালিয়ে।

বিশ্বজুড়ে ছাত্রদের বিক্ষোভ ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিয়েছে। এখানে উল্লেখ করা যায়, ১৯৭৪ সালে গুজরাটে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তৎকালীন রাজ্য সরকার বিরোধী তুমুল জনবিক্ষোভ গড়ে তুলেছিল, যা ‘নবনির্মাণ আন্দোলন’ নামে পরিচিত। তৎকালীন কেন্দ্রের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি তাঁর নিজের দলের মুখ্যমন্ত্রী চিমনভাই প্যাটেলকে পদত্যাগ করিয়ে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করেন। চিমনভাই প্যাটেল কংগ্রেস ত্যাগ করে নিজের দল – ‘কিষান মজদুর লোক প্রকাশ’ গঠন করেন। পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনের পরে ৯ মাসের জন্য গুজরাটে অ-কংগ্রেসি জোট সরকার ক্ষমতায় থাকলেও, ১৯৭৬ সালে গুজরাটে কংগ্রেস পুনরায় ক্ষমতাসীন হয়। উল্লেখ্য, ১৯৯০ সালে বিজেপির সমর্থনে চিমনভাই প্যাটেল পুণরায় গুজরাটে মুখ্যমন্ত্রী।

ভারতে ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে এসেছেন অনেক রাজনৈতিক নেতা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার অর্থ হল সামগ্রিকভাবে কর্মী ও পদাধিকারীদের এবং ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণ করা এবং তাঁরা যা অধ্যয়ন করেন তা নির্ধারণ করা।

গুজরাটে প্রস্তাবিত আইনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনকে খর্ব করবে। এটি সমস্ত প্রশাসনিক এবং অ্যাকাডেমিক নিয়োগের জন্য সরকারকে সম্পূর্ণরূপে ক্ষমতা অর্পিত করবে।

২০২২ সালে, সুপ্রিম কোর্ট গুজরাটের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সর্দার প্যাটেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের এমন একটি নিয়োগ বাতিল করেছিল কারণ তা ইউজিসির নিয়মের পরিপন্থী ছিল।

প্রস্তাবিত কমন ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট যতটা সহজ মনে হয়, ততটা সহজ নয়। গুজরাটের প্রধান শহরগুলির প্রধান স্থানে অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির হাজার হাজার কোটি টাকার জমি রয়েছে।

ভবিষ্যতে উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের নামে সরকার এসব জমি দাবি করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সবরমতি আশ্রম পুনঃউন্নয়ন প্রকল্প এর একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ।

ঈশ্বর আল্লাহ তেরো নাম, সবকো সনমতি দে ভগবান” — মহাত্মা গান্ধীর অন্যতম প্রিয় ভজন — গুজরাট বিদ্যাপীঠের জন্য অতীতের বিষয় হয়ে উঠবে এবং এতে কারো অবাক হওয়া উচিত নয়। সর্বোপরি, আজকাল আর কিছুই আমাদের অবাক করে না।

মহাত্মা গান্ধি-প্রতিষ্ঠিত গুজরাট বিদ্যাপীঠ, একটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়। আহমেদাবাদের এই স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় মহাত্মা গান্ধির মূল্যবোধ ও বিচারধারার শিক্ষা দেয়। ১০৩ বছর বয়সী মর্যাদাপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানের ট্রাস্টের ২৪ জন সদস্য রয়েছেন। এখানে প্রাথমিক শিক্ষা স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত গান্ধীজির

নৈতালিমের আদর্শে শিক্ষা দেওয়া হয়। রাজ্যপালকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর নিয়োগের নির্দেশের প্রতিবাদে ট্রাস্টিদের একটি দৃঢ় ও স্পষ্ট যৌথ বিবৃতি এবং গণ পদত্যাগ, সমাবর্তন অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে এসেছিল। উল্লেখ্য, মহাত্মা গান্ধি তাঁর হত্যা পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানের চ্যান্সেলর ছিলেন এবং পরবর্তীকালে সর্দার প্যাটেল, ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ এবং মোরারজি দেশাইয়ের মতো অন্যান্য বিশিষ্ট নেতা চ্যান্সেলর ছিলেন। যৌথ বিবৃতিতে, নয়জন ট্রাস্টি এই প্রতিষ্ঠানের চ্যান্সেলর হিসাবে গুজরাটের গভর্নরের নিয়োগ ‘অতিরিক্ত রাজনৈতিক চাপ’ – এর ফল বলে অভিমত ব্যক্ত করেন এবং এটিকে ইতিহাসকে ‘মুছে ফেলা এবং পরিবর্তন’ করার একটি পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করেন।

“আমরা নবনির্বাচিত চ্যান্সেলরের কাছে বিনীতভাবে আবেদন করছি, আপনি আপনার নির্বাচনের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত আছেন। এটা স্বতঃস্ফূর্ত বা ট্রাস্টি বোর্ডের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ছিল না। এটা করা হয়েছিল চরম রাজনৈতিক চাপের মুখে। এটি গান্ধিজির মূল্যবোধ, পদ্ধতি এবং অনুশীলনের প্রতি সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত আপনার সম্মান এবং মর্যাদার প্রতি কিভাবে সঙ্গতিপূর্ণ ?” এই বিবৃতি গণমাধ্যমে তাঁরা প্রকাশ করেন।

বিবৃতিতে বলা হয়, ” মহাশয়, গণতন্ত্রের মৌলিক মূল্যবোধ এবং স্বচ্ছ স্বায়ত্তশাসিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য চ্যান্সেলর হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে অস্বীকার করে একটি উদাহরণ স্থাপন করার সুযোগ রয়েছে।”

দৃঢ়তার সঙ্গে তাঁরা বলেন,“যেকোন সুস্থ গণতন্ত্র কেবল আদর্শ – নির্ভর জন-নীতিতে নিহিত হতে পারে। এই ধরনের পদক্ষেপের মাধ্যমে, সরকার বড়, ছোট, শক্তিশালী এবং দুর্বল গান্ধিবাদী প্রতিষ্ঠানগুলি দখল করার এবং এর ফলে ইতিহাসকে মুছে ফেলা এবং পরিবর্তন করার উদ্দেশ্য স্পষ্ট করেছে।”

এর আগে, ৮৯ বছর বয়সী বিশিষ্ট গান্ধিবাদী এবং স্ব-কর্মসংস্থান মহিলা সমিতির (এস ই ডব্লিউ এ) প্রতিষ্ঠাতা ইলাবেন ভাটের বয়সজনিত কারণে পদত্যাগের পরে রাজ্যপাল আচার্য দেবব্রতের নিয়োগের পথ প্রশস্ত হয়েছিল।তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করার পর, বিদ্যাপীঠ বোর্ড রাজ্যের গভর্নরকে চ্যান্সেলর হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করে, তবে তা’ সর্বসম্মত নয়। কারণ পদত্যাগ করা এই নয়জন সদস্য এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন।যাইহোক, আচার্য দেবব্রত আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং ১১ অক্টোবর, ২০২২, চ্যান্সেলর হন।

এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের সাথে আচরণ করার ক্ষেত্রে সরকারের ঔদ্ধত্ত্বপূর্ণ ব্যবহারের নিন্দা করে ট্রাস্টিরা উল্লেখ করেছিলেন যে সরকার এমনকি অনুদান বন্ধ করার এবং বিদ্যাপীঠের বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা প্রত্যাহার করার হুমকি দিয়েছে।অভিযোগ ছিল,“সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বিদ্যাপীঠের লেখা ১৫০ টিরও বেশি চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার পর্যন্ত করা হয়নি।

ট্রাস্টি বোর্ডের যে নয়জন গান্ধিবাদী সদস্য পদত্যাগ করেছিলেন তাঁরা হলেন, নরসিহভাই হাতিলা, ডাঃ সুদর্শন আয়ঙ্গার, ডাঃ অনামিক শাহ, মন্দাবেন পারিখ, উত্তমভাই পারমার, চৈতন্য ভট্ট, নীতাবেন হার্দিকার, মাইকেল মাজগাঁওকর এবং কপিল শাহ।

হিন্দু মহাসভার শীর্ষস্থানীয় নেতা অশোক পান্ডের ও নেত্রী পূজা শকুন পান্ডের এবং বিজেপির সাংসদ প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধি বিরোধী বিতর্কিত বক্তব্যদান এবং কর্মকাণ্ড, তথা গান্ধি হত্যাকারী নাথুরাম গডসেকে মহিমামন্ডিত করা, সংবাদ মাধ্যমে বহুল প্রচারিত।

যে গান্ধিজির বিচার ধারার জন্য ভারত বিশ্বের দরবারে সমাদৃত তা’ রক্ষা করা প্রতিটি ভারতবাসীর পবিত্র কর্তব্য। ঘৃণা, বিদ্বেষ ও হিংসার রোষানলে আক্রান্ত ভারতের মুক্তির পথ সত্য, প্রেম ও অহিংসা – র মন্ত্র।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *