সেলুলার গদ্দারদেরেও মনে রাখে

( অশোক ভট্টাচার্য – এর বিশেষ প্রতিবেদন)ঃ

বিষাক্ত মাকড়সা যেন…

শুধু সাতটি পা, মাঝখানে লম্বা টাওয়ার। পুলিশের চোখ সর্বত্র। এক খোপ থেকে অন্য খোপে রাখা বন্দীদের দেখা যেত। প্রায়ান্ধকার কুঠুরি। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। দ্বীপান্তরের বন্দিদের ঠিকানা আন্দামান সেলুলার জেল ছিলো এমনই।

এখান থেকেই মাদ্রাজের পাগলা গারদকে ঠিকানা হিসেবে বেছে নিতে হয়েছিলো উল্লাসকর দত্তকে। জেলের ভিতর ক্রমাগত অত্যাচারে ও পরিশ্রমে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। সেলুলার জেল থেকে মুক্তি পাবার পর বিপ্লবী বিপিন পালের বিধবা বোন লীলা দেবীকে বিয়ে করে কখনো রামমোহন লাইব্রেরির বারান্দা, কখনো বৌবাজারের পাইস হোটেলের এক কোণে রাত গুজরান হয়েছিলো উল্লাসকরের।

এই সেলুলার জেলে বন্দী অবস্থায় একটি লোক ৩০ আগষ্ট’১৯১১ সালে মুক্তি ভিক্ষা প্রার্থনা করে চিঠি দিলো ব্রিটিশ সরকারের কাছে ; সেই মেরুদণ্ডহীন মানুষটার নাম দামোদর বিনায়ক সাভারকর।

হেমচন্দ্র কানুনগো। ঘটি বাটি বিক্রি করে লন্ডন হয়ে প্যারিস পাড়ি দিয়েছিলেন কেবল বোমা তৈরির ফর্মূলা শিখবেন বলে৷ যাকে বলে ঝাঁ তকতকে কেরিয়ার, তাকে জলাঞ্জলি দিয়ে মেডিকেল কলেজের এবং আর্টের ছাত্র হেমচন্দ্র অগ্নিযুগের বিপ্লবী হয়ে উঠলেন। সেলুলার জেলের কুঠুরিগুলোতে বন্দীদের উপর অত্যাচারের ছবিগুলি কাঠকয়লা দিয়ে বাঙময় হয়ে উঠেছিলো হেমচন্দ্রের হাতেই।

১৯৩৩ এ নলিনী দাস –

এর নেতৃত্বে সেলুলার জেলে শুরু হলো ৩২ দিনের ঐতিহাসিক অনশন। ১৭ মে অনশনের ৭ ম দিনে মহাবির সিং কে জোর করে দুধ খাইয়ে অনশন ভাঙাতে গেলে, তাঁর ফুসফুসে দুধ,আটকে মারা গেলেন মহাবীর সিং। ২৩ মে, অনশনের ১২ তম দিনে মারা গেলেন মোহিত মিত্র। ২৪ মে ১৩ তম দিনে মারা গেলেন মোহন দাস। আর,সেলুলার জেলেই প্রথম মুক্তি ভিক্ষা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর ১৯১৩ সালে আবার মুচলেকা দিয়ে মুক্তি ভিক্ষা চাইলো সাভারকার।

দেওয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে অভিনব টরে টক্কা পদ্ধতিতে বন্দী সহযোদ্ধাদের সাথে বার্তা বিনিময়ের কাজ চালাতেন বারীন ঘোষ, সেলুলার জেলের অত্যাচারে যিনিও কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। এই ভাবেই অনন্ত সিংহ, গনেশ ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় রা যখন কঠিন লোহার ঘুম ভাঙানোর গান বাঁধছেন সেলুলার জেলে, তখন ১৯২১ সাল পর্যন্ত আরো পাঁচ বার মুচলেকা দিয়ে মুক্তি ভিক্ষা চাইলো সাভারকার।

হেমচন্দ্র লিখেছিলেন…

‘‘স্বদেশপ্রীতির একমাত্র লক্ষ্য জাতীয়-শ্রী বা অভ্যুদয়। এটা সম্পূর্ণ ইহলৌকিক বাস্তব (materialistic) ব্যাপার। এই অভ্যুদয় নির্ভর করে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ওপর। বিজ্ঞান ধর্মের হেঁয়ালি ভেঙে দিয়েছে ও দিচ্ছে, তাই ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের ঝগড়া। অর্থাৎ, আধ্যাত্মিক অভ্যুদয়ের সঙ্গে জাতীয় অভ্যুদয়েরও ঝগড়া। স্বদেশপ্রীতি আর ধর্ম, অন্য কথায় জাতীয় অভ্যুদয় (কিংবা ডেমক্রেসি) আর ধর্মতন্ত্র; এ দু’টি জিনিসের মধ্যে যে সম্বন্ধ, আলো আর আঁধারের মধ্যেও ঠিক সেই সম্বন্ধ বিদ্যমান। একটি থাকলে অন্যটি অসম্ভব।’’ আর সেই কারণেই বোধহয় সাভারকাররা যুগে যুগে কক্ষচ্যুত হয়ে শাসকের পায়ে মুচলেকার নৈবেদ্য দান করে।২০০২ সালে এই সাভারকারের নামে পোর্ট ব্লেয়ার বিমানবন্দরের নামকরণ করে অটল বিহারির সরকার। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র একদিন আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের নাম দিয়েছিলেন..

” শহীদ ও স্বরাজ দ্বীপপুঞ্জ”। সেই নাম ঢেকে গেলো — স্বরাজকে বেনিয়াদের কাছে বন্ধক রাখা সাভারকারের নামে। কার হাত ধরে হলো একাজ? সেই মানুষটার নাম অটল বিহারি বাজপেয়ী। ৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় যিনি মুচলেকা দিয়েছিলেন ব্রিটিশদের কাছে। কী অদ্ভুত সমাপতন! আজ আবার দেশে বিজেপি সরকার। আজ আবার নেতাজি র নামাঙ্কিত কোলকাতা বন্দরের নাম ঢেকে দিয়ে নতুন নামকরণ হয়েছে কার নামে? শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নামে, যিনি ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন প্রকাশ্যে ও প্রত্যক্ষভাবে। লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো দেখতে পাবেন এই মুহূর্তে সেলুলার জেল ঘুরতে গেলে। দেখবেন মুচলেকা দেওয়া সাভারকারকে ‘বীর’ সাজানো হয়েছে সেখানে। কয়েকটা সংখ্যা কেবল বদলে দিলে আজও হেমচন্দ্র কানুনগো রচিত রামপ্রসাদী প্যারোডিটি আবার গাওয়া যেতেই পারে…

‘’দেশ বলে যারে বল মনসে ত ত্রিশ কোটীর জেলখানা।তফাত শুধু বুঝে দেখ মন, খাঁচায় আর চিড়িয়াখানা(তার) এ ধারে যা ও ধারেও তা, মাঝখানেতে দেয়ালখানা।’’…

আজ সেই ভবের চিড়িয়াখানার দেওয়াল ভাঙার সময় এসেছে আবার।

“মা গো ভাবনা কেন…”

✒️অশোক ভট্টাচার্য ( রাজা)

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *