বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও তাঁর অবিস্মরণীয় জীবন কাহিনী

শান্তনু দত্তচৌধুরী

আজ ১১ জৈষ্ঠ্য বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫ তম জন্মদিন।কবি নজরুলের জন্ম বর্ধমানের চুরুলিয়া গ্রামে এক কৃষক পরিবারে। জন্ম বাংলা ১১ জৈষ্ঠ্য , ১৩০৬ সন। ইংরেজি ২৪ মে , ১৮৯৯ সাল।

পিতা ফকির আহমেদ।মা জাহেদা খাতুন।এই কৃষক পরিবারের সন্তানই পরবর্তী জীবনে ‘ বিদ্রোহী কবি ‘ বলে অবিভক্ত বাংলা ও উপ মহাদেশে পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর অগ্নিবর্ষী লেখনী ও গান ব্রিটিশ রাজশক্তির মনে ত্রাসের সঞ্চার করেছিল। যেখানে যত অবিচার সেখানেই তিনি গানে কবিতায় আঘাত হেনেছেন— সাম্যের গান গেয়েছেন, নারীমুক্তির বন্দনা রচনা করেছেন, ধর্মান্ধতাকে কশাঘাত করেছেন। এই কবিই ফাসির মঞ্চে জীবনের জয়গান শুনিয়েছেন। ‘অগ্নিবীণা’, ‘দোলন চাপা’ প্রভৃতি বই-এ এবং গজল = গানগুলিতে তার রচনার বিভিন্ন দিক পাশাপাশি রুদ্র, বীর, করুণ ও মধুর রসের অভিব্যক্তি ঘটেছে। শুধু ভাবের অভিব্যক্তি নয়, ভাষার ওজস্বিতার জন্যও তিনি জনপ্রিয় ছিলেন। আর ছিল তাঁর মনপ্রাণ মাতান দরাজ কন্ঠের গান। যে আসরে তিনি উপস্থিত থাকতেন, গানে কবিতায় হাসি গল্পে সে আসর জমজমাট হয়ে উঠতো।

বাল্যকালে বাবাকে হারিয়ে তাঁকে কঠোর জীবনসংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়। ১০ বছর বয়সে মক্তবে নিম্ন-প্রাথমিক পরীক্ষা পাশ করে ঐ মক্তবেই এক বছর পড়ান। বাল্যকালে সাধু সন্ন্যাসী বাউল ফকিরদের সঙ্গলাভ করতে ভালবাসতেন। বাল্য বয়সেই ‘লেটো’ নাচের দল ও বাউল ফকিরদের সংস্পর্শে আসায় তাঁর মধ্যে কবিত্ব শক্তির উন্মেষ হয়। সুর ও গান আত্মস্থ করতে থাকেন।ওই বালক বয়সে কাহিনী ও গান রচনা করে অর্থ উপার্জন করেছেন। গানে সুর-সংযোজনা করতে শেখেন।

এক সময় গ্রাম ছেড়ে আসানসোলের এক রুটির দোকানে’ ৫ টাকা বেতনে কাজ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় শিয়ারশোল রাজ হাইস্কুলের দশম শ্রেণীর কৃতী ছাত্র নজরুল দেশপ্রেমের আহ্বানে বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দিয়ে সৈনিক হন। ১৯১৭ – ১৯ খ্রী. সেনাবাহিনীতে ছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে হাবিলদার নজরুল বাঙলাদেশের পত্রিকার জন্য বহু গল্প, কবিতা, গান প্রভৃতি লিখে পাঠাতেন। ১৯১৯ খ্রী. ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায়’ তার ‘মুক্তি’ কবিতা প্রথম ছাপা হয়। এই পত্রিকাতেই ‘ব্যথার দান’ ও ‘হেনা’, গল্প-দুটি ১৯১৯ খ্রী: ছাপা হয়। এই প্রেমের গল্প-দুটিতে লেখকের দেশপ্রেম ও আন্তর্জাতিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। মার্চ ১৯২০ খ্রী. ৪১নং বেঙ্গলী রেজিমেন্ট থেকে কলিকাতায় চলে আসেন ও পত্র-পত্রিকায় লেখা দিতে থাকেন। ‘মোসলেম ভারত’-এর প্রথম শ্রেণীর পত্রিকা হওয়ার পেছনে তাঁর অবদান ছিল। ১২.৭-১৯২০ খ্রী. তাঁর ও মুজফ্ফর আহমদের সম্পাদনায় দৈনিক ‘নবযুগ’ প্রকাশিত হয়। এর সম্পাদকীয় স্তস্তে তিনি অনেক উদ্দীপনাময় আবেগপূর্ণ প্রবন্ধ লেখেন। তাঁর অনেকগুলি ‘যুগবাণী’ নাম দিয়ে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। উক্ত পত্রিকায় তাঁর লেখা ‘মুহাজিরিন হত্যার জন্য দায়ী কে’ প্রবন্ধটির জন্য সরকার পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়। পরে দু’হাজার টাকা জমা দিয়ে ‘নবযুগ’ আবার বার হয়েছিল। ১২-৮-১৯২২ খ্রী: রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাণী মাথায় বহন করে তার সম্পাদনায় সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ধূমকেতু’ আত্মপ্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গেই শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে সাড়া জাগায়।

কবিগুরু তাঁর বাণীতে লিখলেন :–

” আয় চলে আয় রে ধূমকেতু

আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু

দুর্দিনের এই দূর্গ শিরে

উড়িয়ে দে তোর বিজয়কেতন

অলক্ষণের তিলক রেখা

রাতের ভালে হোক না লেখা

জাগিয়ে দেরে চমক মেরে

আছে যারা অর্ধচেতন।”

১৩-১০-১৯২২ তারিখের ‘ধূমকেতু’-তে নজরুল লিখলেন, “সর্বপ্রথম ‘ধূমকেতু’ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়।…. ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীর অধীন থাকবে না। ….. প্রার্থনা বাআবেদন-নিবেদন করলে তারা (বিদেশীরা ) শুনবেন না।…..আমাদের এই প্রার্থনা করার, ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকুকে দূর করতে হবে।” দ্ব্যর্থহীন পরিষ্কার ভাষায় কাগজে ঘোষণা করে পূর্ণ-স্বাধীনতার দাবিকে বাংলা দেশে তিনিই তুলে ধরেছিলেন। স্বাদেশিকতার‌ বাণী প্রকাশ ও প্রচার বৃদ্ধি পাওয়ায় ফলে সরকার পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়। রাজদ্রোহের অভিযোগে ১৯২২ সালের ২৩ নভেম্বর তিনি গ্রেপ্তার হয়ে ১৬ ই জানুয়ারি, ১৯২৩ এ বিচারে এক বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। হুগলী জেলে তাঁকে সাধারণ কয়েদীর পর্যায়ে নামিয়ে দেওয়া হলে তিনি তাঁর রাজনৈতিক সহবন্দীদের সঙ্গে নিয়ে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। দীর্ঘদিন অনশন চলছে দেখে রবীন্দ্রনাথ শিলং থেকে টেলিগ্রাম করেন, ” অনশন ত্যাগ কর। আমাদের সাহিত্য তোমাকে দাবি করে (Give up hunger strike, our literature claims you)।” ৩৯ দিন পরে অনশন প্রত্যাহৃত হয়। বিশেষ শ্রেণীর কয়েদী হয়ে তিনি বহরমপুর ডিস্ট্রিক্ট জেলে বদলী হন। নজরুল আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে থাকার সময় রবীন্দ্রনাথ তার ‘বসন্ত’ নাটকটি নজরুলকে উৎসর্গ করেছিলেন। জেলে বসেই ‘ মোদের শিকল পরা ছল’ ও অন্যান্য কয়েকটি গান রচনা করেন। ১৯২৩ সালের ডিসেম্বরে জেল থেকে মুক্তি পান। ১৯২৪ সালে কুমিল্লার গিরিবালা দেবীর কন্যা প্রমীলা সেনগুপ্তকে বিবাহ করেন। এই সময় তিনি হুগলীতে থাকতেন। বহু বিখ্যাত গান ও কবিতার রচনাস্থল হুগলী। ा

১৯২৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর নজরুল প্রকাশ করলেন নতুন পত্রিকা লাঙল। এবারেও লাঙল-এর সূচনায় থাকলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

তিনি লিখলেন :–

ধর হাল বলরাম

আন তব মরু-ভাল হল

বল দাও ফল দাও স্তব্ধ হোক ব্যর্থ কোলাহল।

এরই মাঝে নজরুল ইসলাম কবিতা ও গানের অনেকগুলো বই নিয়ে বের করলেন সঞ্চিতা। উৎসর্গ বাক্যে লিখলেন, ‘ বিশ্বকবি সম্রাট শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রী শ্রী চরণারবিন্দেষু।’ ‘ লাঙ্গল ‘ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় (২৫-১২-১৯২৫) তার “সাম্যবাদী’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকার প্রধান পরিচালক হিসাবে তাঁর নাম লেখা হত। পত্রিকাটির সম্পাদক হিসাবে নাম থাকত তাঁর বাঙ্গালী পল্টনের বন্ধু মণিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ১৯২৬ খ্রী কৃষ্ণনগরে এসে বাসা করেন। বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সদস্য হিসাবে কৃষ্ণনগরে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক কংগ্রেসের সম্মেলনে স্বেচ্ছাসেবকবাহিনী গঠন করে তাদের কুচকাওয়াজ শেখানোর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রাদেশিক সম্মেলনের জন্য ‘ কাণ্ডারী হুঁসিয়ার’ গানও ঐ সময়ে রচিত হয়। ছাত্র সম্মেলনের জন্য রচনা করেন “আমরা শক্তি, আমরা বল, আমরা ছাত্রদল।’ কৃষ্ণনগরে তাঁর বাড়ির সাহিত্য বৈঠকে অনেকে আসতেন। হেমন্তকুমার সরকারের সহযোগে তিনি একটি শ্রমজীবী নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। ১৯২৮ খ্রী- কৃষ্ণনগর ছেড়ে কলিকাতায় এসে গ্রামোফোন কোম্পানীতে কাজ পান। এই সময়ের মধ্যে গায়ক, গান -রচয়িতা ও সুরকার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। রাজনীতির সঙ্গে সংযোগ থাকার কারণে এতদিন যে ব্রিটিশ গ্রামোফোন কোম্পানী তাঁকে দুরে রেখেছিল, এখন তারাই তাঁকে আহ্বান জানায়। প্রথমে গানের ট্রেনার ও পরে কম্পোজারও হয়েছিলেন। তার রচিত গানের সংখ্যা তিন হাজারের মত। সবাক ছবির সূচনা থেকে তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গীত রচনা ছাড়া তিনি ‘বিদ্যাপতি’, ‘সাপুড়ে’, ‘ধ্রুব’ প্রভৃতি ছবির কাহিনীকারও ছিলেন।

সুরের রাজ্যে বিচরণের সঙ্গে সঙ্গে তিনি আধ্যাত্মিকতার দ্বারাও ে প্রভাবিত হন। লালগোলা হাইস্কুলের প্রধানশিক্ষক বরদাচরণ মজুমদারের কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন। ১৯৩৯ সালে তাঁর স্ত্রী প্রমীলা দেবী পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে যান। ঐ বছরই তিনি তাঁর যাবতীয় পুস্তকসহ গ্রামোফোন কোম্পানীর রেকর্ডে তাঁর সমস্ত গানের রয়ালটি কলিকাতা হাইকোর্টের এটর্নি অসীমকৃষ্ণ দত্তের কাছে চার হাজার টাকার বিনিময়ে বন্ধক রাখেন। ১৯৪২ সালে তিনি নিজেই পক্ষাঘাতে বোধশক্তিহীন নীরব নির্বাক হয়ে যান। নজরুল সাহায্য কমিটির চেষ্টায় বঙ্গীয় সরকার তাকে মাসিক দু’শ টাকা সাহিত্যিক বৃত্তি মঞ্জুর করেছিল। ১৯৫৩ সালে চিকিৎসার জন্য সন্ত্রীক তাঁকে ইউরোপে পাঠান হয়। কিন্তু সেই চিকিৎসায় তাঁর নীরবতা ভঙ্গ হলনা। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তাঁকে বাংলাদেশে নিয়ে গিয়ে তাঁর চিকিৎসা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার ব্যাবস্থা করেছিলেন। কিছুদিন পরে তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয় এবং ১৯৭৫ সালের শহিদ দিবসে তাঁকে ‘একুশে পদক’ দিয়ে সম্মানিত করা হয়। তখন তাঁর শরীর একেবারেই ভেঙে পড়েছে।২৯ আগস্ট ১৯৭৬; ( বাংলা – ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) ঢাকায় তাঁর মৃত্যু হয়। রাষ্ট্রীয় সম্মানে তার দেহ সমাধিস্থ করা হয়।

** কৃতজ্ঞতা স্বীকার — সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান , সাহিত্য সাধক চরিতমালা , মুক্তির সংগ্রামে ভারত, আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি — মুজফ্ফর আহমেদ প্রণীত।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *