শুভাশিস মজুমদার
সুরাটের আদালত (চিফ ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট) ২০১৯ সালে কর্ণাটকে (কোলার)জনসভায় রাহুলকে ‘মোদী’ উপাধি এবং ‘চোর’ উল্লেখ করা মন্তব্যের কারণে গত ২৩ মার্চ মানহানির জন্য দোষী সাব্যস্ত করেছে এবং তাঁকে দুই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে, যা মানহানি মামলার প্রায় নজিরবিহীন সর্বোচ্চ সাজা। এরপর তড়িঘড়ি করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তাঁর লোকসভায় সদস্যপদ বাতিল করা হয়। পরে ওই আদালতের সেশন জাজ কনভিকশন রদ না করলেও রাহুল গান্ধির জামিনের মেয়াদ বাড়িয়ে দেন। কংগ্রেস সহ সমস্ত বিরোধীদল এককাট্টা হয়ে রাহুল গান্ধির সংসদে সদস্যপদ বাতিল হওয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। তাঁরা একে জোর করে অন্যায় ভাবে অগণতান্ত্রিক উপায়ে রাহুল গান্ধির মুখ বন্ধ করার কৌশল বলে অভিযোগ করেন, যাতে রাহুল প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সংসদে কথা বলতে না পারেন এবং পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন।
২০১৯ সালে রাহুল গান্ধি কোলারের জনসভায় ললিত মোদী, নিরব মোদী (বহু কোটি টাকার ব্যাঙ্ক ঋণ পরিশোধ না করে বিদেশে পলায়নের অপরাধী) এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে (বহু বিতর্কিত নোটবাতিলের কর্তা) চোর বলে উল্লেখ করেন। এবং প্রশ্ন করেন, সব চোরদের পদবি মোদী কেন ? তাঁর এই মন্তব্যের লক্ষ্য কারা তা’ খুব স্পষ্ট ছিল। একইসঙ্গে তিনি বিজয়মাল্য ও মেহুল চক্সির নাম উল্লেখ করেছিলেন – তাঁরাও ব্যাঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করে দেশত্যাগ করেছেন। গুজরাটের প্রাক্তন মন্ত্রী ও বিধায়ক পূর্ণেশ মোদী অভিযোগ করেন, রাহুলের বক্তব্যে সারা মোদী সমাজ অপমানিত হয়েছে। ২০২১ অক্টোবরে কোর্টে রাহুল গান্ধির বক্তব্য রেকর্ড করা হয়। এরপর পূর্ণেশ মোদী আবারও রাহুল গান্ধিকে কোর্টে এসে বক্তব্য পেশ করার আবেদন জানালে কোর্ট তা’ খারিজ করে দেয়। আশ্চর্যজনকভাবে মার্চ ২০২২ এ পূর্ণেশ মোদীর আইনজ্ঞ গুজরাট হাইকোর্টে গিয়ে এই মামলায় স্থগিতাদেশ নেন। অনেকের মতে এই মামলার রায় আশানুরূপ হবে না, এই আশঙ্কায় তিনি এই কাজ করেন। মার্চ ২০২৩ এ আদানি ইস্যুকে সামনে এনে রাহুল গান্ধি যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উপর আক্রমণাত্মক, সেই সময় গুজরাট হাইকোর্ট থেকে এই মামলার স্থগিতাদেশ তুলে নেওয়া হয়। ইতিমধ্যে সুরাটের ওই আদালতের চিফ ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট পরিবর্তিত হয়েছে, স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন জাস্টিস এইচ এইচ বার্মা। নতুন করে শুরু হয় মামলা। জাস্টিস বার্মা রাহুল গান্ধিকে দু বছরের কারাদণ্ড দেন। এরপর রাহুল গান্ধি সুরাটের সেশন কোটে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। এই মামলার বিচারক রবিন পাল মোগেরা ঘটনাক্রমে ২০০৬ সালের তুলশীরাম প্রজাপতি ভুও এনকাউন্টার মামলায় অমিত শাহের উকিল ছিলেন, বলে খবরে প্রকাশ। অন্তত ২০১৪ সাল অবধি তিনি এই দায়িত্বে ছিলেন।
বিচারক রবিন পাল মোগেরা রাহুলের জামিন মঞ্জুর করলেও দোষী সাব্যস্ত হওয়া রায়ের উপরে স্থগিতাদেশ দেননি।
আশ্চর্যজনকভাবে ২৬ এপ্রিল বুধবার গুজরাট হাইকোর্টে এই মামলার দায়িত্বে থাকা জাস্টিস গীতা গোপী নিজেকে এই মামলা থেকে সরিয়ে নেন। তাঁর জায়গায় জাস্টিস প্রাচ্ছক দায়িত্ব পান।
রাহুল গান্ধি ২৯ এপ্রিল, শনিবার, মানহানির জন্য তাঁর দোষী সাব্যস্ত হওয়ার উপর গুজরাট হাই কোর্টে স্থগিতাদেশ চান। তাঁর আইনজীবী গুজরাট হাইকোর্টকে বলেন, যে অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হয়েছিল তা গুরুতর নয় এবং এতে “নৈতিক স্খলন” জড়িত নয়।অ্যাডভোকেট অভিষেক মনু সিংভি আরও যুক্তি দেন যে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার উপর স্থগিতাদেশ অস্বীকার করা রাহুলের জন্য “অপরিবর্তনীয়” পরিণতি হতে পারে।সিংভি বলেন, সাংসদ হিসাবে অযোগ্য হওয়ার আগে রাহুল যে ওয়েনাড কেন্দ্রের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, তার জন্য যদি একটি উপ-নির্বাচন হয়, তবে কংগ্রেস নেতা পরে তাঁর দোষী সাব্যস্ত হওয়ার বিরুদ্ধে আবেদন জিতে গেলেও এর ফলাফল বাতিল করা যাবে না।
সিংভির যুক্তির পরে, অভিযোগকারীর প্রতিনিধিত্বকারী অ্যাডভোকেট নিরুপম নানাবতী বিজেপি বিধায়ক পূর্ণেশ মোদীর উত্তর দেওয়ার জন্য সময় চেয়ে নেন। হাইকোর্ট শুনানি ২ মে পর্যন্ত মুলতবি করে।সিংভি বিচারপতি হেমন্ত প্রাচ্ছকের সামনে যুক্তি দেন যে ছয়টির মতো গুরুতর ত্রুটি এই বিচারকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।”বিচারের প্রক্রিয়া সম্পর্কে গুরুতর আশংকা তৈরি হয়েছে।” তিনি যুক্তি দেন, একটি জামিনযোগ্য এবং আদালতে অগ্রহনযোগ্য (নন – কগ্নিজাবেল) অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হয়েছে।সিংভি জিজ্ঞাসা করেন, কেন পূর্ণেশ সাজা স্থগিত করার জন্য দায়রা আদালতে রাহুলের আবেদনকে চ্যালেঞ্জ করেননি ? কারন তা এমপি হিসাবে তাঁকে (রাহুলকে) পুনর্বহাল করতে পারে না। তবে রাহুল গান্ধির দোষী সাব্যস্ত হওয়ার রায়ের উপর স্থগিতাদেশের আবেদনকে চ্যালেঞ্জ করেন পূর্নেশ। যা উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে ইঙ্গিত করেন তিনি।আইনজীবী সিংভি পূর্ণেশের “রাহুল গান্ধির সাংসদ পদ খারিজের প্রতি সম্ভাব্য আগ্রহ” নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
পূর্ণেশ অভিযোগ করেছেন, রাহুলের মন্তব্যে নাকি ১৩ কোটি মানুষের মানহানি হয়েছে, যা হাস্যকর বলে সিংভি জানতে চান, যদি সত্যিই তাই হয়, তাহলে একটি মন্তব্যের জন্য কি কোটি কোটি মানুষ আদালতে মামলা করবেন !
“প্রকৃতপক্ষে মোদী সমাজ বা সম্প্রদায় বলে কিছু নেই। গুজরাটে বণিক, রাঠোর, তেলি সম্প্রদায়ের মানুষেরা মোদী পদবি ব্যবহার করেন।” সিংভির আরও দাবি, পূর্ণেশ মোদীর প্রকৃত পদবি ছিল ভুটওয়ালা, যা তিনি বদল করেছেন।
এদিকে, গুজরাট হাই কোর্ট ২ মে রাহুলের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার রায়ের উপর কোন অন্তর্বর্তীস্থগিতাদেশ দিতে অস্বীকার করে বলে, গ্রীষ্ম কালীন ছুটির পরে জুন মাসে চূড়ান্ত রায় দেওয়া হবে।উল্লেখ্য, জাস্টিস হেমন্ত প্রাচ্ছক ২০০২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত গুজরাটের (মোদী সরকারের) সহায়ক সরকারি উকিল ছিলেন। এরপর ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত গুজরাটে কেন্দ্রীয় সরকারের স্থায়ী উকিল ছিলেন। তিনি ২০২১ সালের ১৮ অক্টোবর গুজরাট হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন।