মহিলা সংরক্ষণ বিল: নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদি সরকারের আরেকটা জুমলা

অমিতাভ সিনহা

অবশেষে পাস হল মহিলা সংরক্ষণ বিল।রাজীব গান্ধি স্বপ্ন দেখেছিলেন দেশের মহিলারা যেমন সুচারুভাবে সংসার সামলে চলেন , তেমনি সুযোগ পেলে তাঁরা দেশের সরকারও চালাতে পারবেন একদিন।তাই তিনি পুরসভা ও পঞ্চায়েতে মোট আসনের তিন ভাগের একভাগ মহিলাদের জন্য সংরক্ষণের আইন প্রণয়ন করতে চেয়েছিলেন।তখন বিজেপি বাধা দিয়েছিল।পরবর্তীকালে কংগ্রেসের আমলে ১৯৯৩ সালে নরসিংহ রাওয়ের প্রধানমন্ত্রীত্ব কালে সংবিধানের ৭৩ ও ৭৪ তম সংশোধনীর মাধ্যমে পুরসভা ও পঞ্চায়েতে তিন ভাগের একভাগ মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ করা হয় এবং তা অতি সত্বর লাগু করা হয়। মনে আছে ১৯৯৫ সালে কলকাতা পৌরসভা বা বিধাননগর পৌরসভাসহ রাজ্যের বিভিন্ন পুরসভাগুলিতে এই সংরক্ষণ চালু করা হয়।তারপর থেকেই শুরু হল মহিলা ক্ষমতায়নের এক নতুন যুগ।হিসাব বলছে ১৭ তম লোকসভায় মোট সদস্যদের মধ্যে মহিলারা মাত্র ১৫ শতাংশ।রাজ্য বিধানসভায় মোট সদস্যদের মধ্যে মহিলারা মাত্র ৯ শতাংশ। দেশের হাইকোর্টগুলিতে এযাবৎ নিয়োগ হওয়া ৭৮৮ জন বিচারপতির মধ্যে সর্বসমেত ১০৭ জন মহিলা বিচারপতি নিয়োজিত ছিলেন।সুপ্রীমকোর্টে গত ৭৩ বছরে ২৬৮ জন নিয়োগ হওয়া বিচারপতির মধ্যে মাত্র ১১ জন মহিলা বিচারপতি। মাত্র ৪ শতাংশ। এরপর একাধিকবার মহিলাদের জন্য লোকসভা ও বিধানসভায় সংরক্ষনের জন্য বিল এসেছে।১৯৯৬,১৯৯৮,১৯৯৯ সালে এই বিল পাস করা যায় নি কারণ লোকসভা ভেঙে যাওয়ায়।এরপর মনমোহন সিং এর প্রধানমন্ত্রীত্বে কংগ্রেসের আমলে আবার চেষ্টা হয় এই সংরক্ষণের।রাজ্যসভাতে তা পাস হলেও লোকসভার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় এই বিল আইনে পরিণত করা যায় নি।এরপর কেটে গেছে পনের বছর। হঠাৎ বিজেপি সরকার কারও সাথে বিন্দুমাত্র আলোচনা না করে সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডেকে অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে মহিলা বিল পাস করাতে গেল কেন তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। মহিলাদের ক্ষমতায়ন তো তাদের এজেন্ডায় নেই,তাহলে?এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে বিলের মধ্যেই। সংবিধানের ১২৮ তম সংশোধনী বলছে খুব তাড়াতাড়ি এই বিল আইনে পরিণত হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।অন্ততঃ অর্ধেক রাজ্যর বিধানসভায় পাস করানো ছাড়াও জনগণনা অর্থাৎ সেনসাস করার পর আসন পুনর্বিন্যাস বা ডিলিমিটেশন , প্রায় বছর দশেকের ব্যাপার।২০২৯ সালের মধ্যে তো হবেই না,হয়তো ২০৩৯ সালও লেগে যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা।এই ডিলিমিটেশন বা আসন পূনর্বিন্যাস করতে একটা বিরাট সময় লাগে।এরফলে ভাল ফল করা রাজ্যগুলি যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হয় তেমনি খারাপ ফল করা রাজ্যগুলি লাভবান হয়।এটাই শেষ নয়।জাতগণনার দাবী দীর্ঘদিনের।যা কংগ্রেসসহ বিরোধী দলগুলি দাবী করলেও বিজেপি তা এড়িয়ে যাচ্ছে। তাদের নেত্রী উমা ভারতী বিরোধীদের সাথে সুর মিলিয়ে একই দাবী করেছেন।তিনি ওবিসি সংরক্ষণের দাবী জানিয়েছেন।আসলে হিন্দুত্বের জোর কমেছে।রামমন্দিরের উদ্বোধন হবে কিছুদিনের মধ্যে,লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে।কর্ণাটক ও হিমাচল প্রদেশে ব্যাপক হার বিজেপিকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলেছে।এরপর রয়েছে চারটি বড় রাজ্যে নির্বাচন, মধ্যপ্রদেশ,রাজস্থান, ছত্রিশগড় ও তেলেঙ্গানা। কোন রাজ্যেই বুকে হাত দিয়ে বিজেপি নেতারা জয়ী হবই এই কথাটি বলতে পারছে না।চিন যে দেশের অনেকটা জমি দখল করে নিয়েছে তা আর চাপা দেওয়া যাচ্ছে না। ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্ব এবং আদানী কেলেঙ্কারির সঙ্গে মোদির যোগ আজ জনগণ অবিশ্বাস করছে না।মোদির জুমলা বা মিথ্যার বেসাতি মানুষ ধরতে পেরে গেছে।তাই যতই মোদি ইশ্বরের দূত হিসাবে নিজেকে প্রচার করুন, এই বিল পাস করানোর ক্ষেত্রে তা মহিলারা কতটা বিশ্বাস করবেন , তা জানতে গেলে অপেক্ষা করতে হবে আরো কয়েকমাস।তিন তালাক বাতিল করা হয়েছিল কি মুসলীম সমাজের উন্নতির জন্য নাকি মুসলমান মহিলাদের ভোট পাওয়ার লক্ষে? নির্বাচন দোরগোড়ায়। যেন তেন প্রকারেন ক্ষমতালাভ প্রধান উদ্দেশ্য বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদির।আরএসএসও ততটা ভরসা দিতে পারছে না।তাই দেশের মহিলাদের ভোট ও সমর্থন জরুরী। বলুন তো কেন এই বিলম্ব? কেন এখনই এই সংরক্ষণ চালু করা যাবে না? কংগ্রেস যদি আইন প্রণয়ন করার সাথে সাথে তা কার্যকর করতে পারে তাহলে ২০২৩ সালের বিল কেন আইনে পরিণত করে কার্যকর করা যাবে না? আসলে সদিচ্ছার অভাব বললে কম বলা হবে।বিজেপি দল হিসাবে চায় না এই আইনটিকে।শুধুমাত্র মোদির স্বপ্ন আবার জিতে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্যেই এই জুমলা বা মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়েছে।তারা ক্ষমতায় থাকলে এটি আইনে পরিণত হবে না।ইচ্ছা থাকলে বিজেপি দশ বছর সময় ব্যয় না করে মহিলা সংরক্ষণ বিল আইনে পরিণত করে এখনই তা কার্যকর করতে পারতো। ২০২৪ সালের নির্বাচনে তা লাগু করল না কেন? এই প্রশ্ন তো উঠবেই।মনে রাখতে হবে একসময় এই হিন্দুত্ববাদীরাই বাধা দিয়েছিল হিন্দু মহিলাদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার প্রশ্নে। বহু বিবাহ সমর্থন করে তারা হিন্দু কোড বিলের বিরোধিতা করেছিলো। সারা দেশ জুড়ে মহিলাদের ওপর একের পর এক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। নরেন্দ্র মোদি নিশ্চুপ।গত বছর ১৫ আগষ্ট সকালে তিনি লাল কেল্লা থেকে ভাষণে নারীদের সম্মান করার কথা বললেন, আর বিকালে বিলকিস বানুর ধর্ষক ও তাঁর মা, বোন, শিশু কন্যার হত্যাকারি ১১ জন খুনিকে গুজরাট সরকার মুক্তি দিল। মণিপুরে কি হচ্ছে? মোদির মুখে কেনো কথা নেই ? মহিলা কুস্তিগিররা মোদির দলের এম পি ব্রিজভূষণ স্মরণ সিং সম্পর্কে যে মারাত্মক অভিযোগ এনেছেন, তার পরেও কেনো মোদি- শাহ নিশ্চুপ। হাথরাস , উননাও , কাটুয়া প্রতিটি ঘটনা মারাত্মক নারী বিরোধী হিংস্রতার নিদর্শন। আসলে সংকীর্ণ রাজনীতির স্বার্থেই এই তাস খেলা হল,মহিলাদের বিভ্রান্ত করে। এখনই এই সংরক্ষণ চালু করলে বহু আসন থেকে মহিলাদের প্রার্থী করতে হবে। তখন সব বাহুবলি এম পিরা যাবেন কোথায়?

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *