বিশেষ কয়েকজন সঞ্চালককে বয়কটের পথে গেল ইন্ডিয়া জোট

অমিতাভ সিংহ

কয়েকদিন আগে ইন্ডিয়া জোট সাংবাদিক সম্মেলন করে দেশের ১৪ জন টিভি উপস্থাপক বা সঞ্চালক বা অ্যাঙ্করকে বয়কটের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে।এইসকল উপস্থাপকেরা গত দশ বছর ধরে বিতর্কের নামে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে ক্রমাগত ঘৃণা ছড়াচ্ছিল । শুধু তাই না তারা পরোক্ষভাবে হিংসাতে ইন্ধন জোগাচ্ছিল।সন্ধে পাঁচটা থেকে ন’ টা কেউ ওইসব চ্যানেলগুলি খুললেই এইসব উপস্থাপকদের কুকীর্তি দেখতে পেতেন।গোদী মিডিয়ার অংশ এইসব চ্যানেলে সারাদিন হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিভেদ ছড়ানো ছাড়া আর কোন সংবাদ পরিবেশন করতে দেখা যেত নাগত কয়েকবছর ধরে দেশে গোদী মিডিয়া বলে একটি শব্দগুচ্ছ বহুল প্রচারিত ও আলোচিত। কিন্তু এই গোদী মিডিয়া জিনিসটা কি? গোদী মিডিয়া তাদেরই বলে যারা শাসকপক্ষের গোদ বা কোলে বসে কাজ করে।অর্থাৎ পক্ষপাতমূলক সংবাদ পরিবেশন করে শাসকদল যেমনভাবে নির্দেশ দেয়।তারা সমাজকে প্রভাবিত করতে চরমতম মিথ্যার আশ্রয় নেয়।তারাই হয় সরকারের মাউথপিস।যে ১৪ জন জাতীয় টিভি চ্যানেলের উপস্থাপককে এই জোট বয়কট করল, তারা হলেনআজতকের সুধীর চৌধুরি ও চিত্রা ত্রিপাঠী ; রিপাবল্কিকের অর্ণব গোস্বামী; নিউজ ১৮ এর অমিশ দেভগণ,আমন চোপড়া ও আনন্দ নরসিংহ ; টাইমস নাউ এর নাভিকা কুমার ও সুশান্ত সিনহা; ভারত-২৪ এর রুবিকা ; ইন্ডিয়া টুডের গৌরব সাওন্ত ও শিব তারুর;ইন্ডিয়া টিভির প্রাচি পরাশর; ভারত এক্সপ্রেসের অদিতি ত্যাগী ও ডিডি নিউজের অশোক শ্রীবাস্তব।কংগ্রেস মুখপাত্র পবন খেরা বলেন আমরা অতীব দুঃখের সঙ্গে বলছি যে গত নয় বছর ধরে নিয়মিত বিরোধীদের বক্তব্য বিকৃত করা,ভুযা খবর ছড়ানো ও একই সাথে ঘৃণা ছড়ানো ও হিংসায় মদত দেওয়ার কারণে এই জোট সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে আমরা এই ১৪ জন উপস্থাপককের কোন বিতর্কসভায় অংশগ্রহন করব না।আমরা চ্যানেলকে বয়কট করছি না,কিন্তু এইসব সঞ্চালক বা উপস্থাপককে বয়কট করছি।কারণ এইসব সঞ্চালকেরা ঘৃণা ছড়ানোর সীমা পার করে ফেলেছে।এরা সন্ধে হলেই বিতর্কের নামে বিরোধীদের অনৈতিকভাবে কিভাবে চূড়ান্তভাবে অপদস্থ করা যায় তার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করে। সাধারণত একটি শো তে একজন বিজেপির ও একজন কংগ্রেসের প্রতিনিধির সঙ্গে একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আরেকজন বিশেষজ্ঞ হিসাবে ডাকা হয়।এই তথাকথিত বিশ্লেষক বা বিশেষজ্ঞ হিসাবে যাদের ডাকা হয় তারা সবাই বিজেপি বা আরএসএসের ঘোর সমর্থক।ফলে এই তিনজন একজোট হয়ে সঙ্গে সঞ্চালককে নিয়ে গলার শির ফুলিয়ে বিরোধীদের বিরুদ্ধে নোংরা ভাষা ব্যবহার করে।এমনকি তৎকালীন কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীকে নোংরা ভাষায় আক্রমণ করতে এদের রুচিতে বাধে নি।ভারতীয় সংস্কৃতিতে যে মহিলাদের সম্মান দেওয়ার কথা বলা আছে তা বিজেপি নেতার বিশেষণ “কংগ্রেসের বিধবা” শব্দবন্ধতেই পরিষ্কার। সুতরাং নেতারা যেখানে এইসব শব্দ ব্যবহার তখন তাদের পোষ্য সাংবাদিক ও চ্যানেলের মালিকেরা একই পথ ধরবে তাতে আর আশ্চর্য কি? বিতর্কে বিজেপির বিরুদ্ধে কোন প্রশ্ন করলে বা বিজেপি গোষ্ঠীর বক্তাদের কোন প্রশ্নের জবাব দিতে দেওয়া হয় না,তাদের মাইক্রোফোন বন্ধ করে দেওয়া হয়।যেমন করে সংসদে রাহুল গান্ধির মাইক্রোফোন বার বার বন্ধ করে দেওয়া হয়, যখনই তিনি আদানী- মোদী সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।এই ঘোষণার পরে বিজেপি নেতারা ও ঐসব সঞ্চালকেরা ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা অর্থাৎ গোদী মিডিয়া প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছিল যে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইন্ডিয়া জোট প্রেসের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করতে চাইছে।সঙ্গে সঙ্গে কংগ্রেসের মুখপাত্র পবন খেরা পরিষ্কার করে জানিয়েছেন যে তারা কোন নিউজ এজেন্সি বা চ্যানেলকে বয়কট করছে না,তারা শুধুমাত্র কিছু অভব্য সঞ্চালকের কোন অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থাকার কথা বলেছে।গণতান্ত্রিক দেশে একজন মানুষের এই অধিকার নিশ্চয় আছে। তিনি এও জানিয়েছেন ঐসব সঞ্চালকের ওপর কোন ব্যক্তিগত ঘৃণা নেই।এই যে হঠাৎ বিজেপি গণতন্ত্রের বুলি আওড়াচ্ছে তাদের ইতিহাসটা যে কি তা তারা বার বার প্রমাণ করে দিয়েছে।২০১৪ সালে দিল্লী প্রেস ক্লাবে হামলা থেকে আরম্ভ করে একের পর এক সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ নেমে এসেছে। তাদের সঙ্গে মতবিরোধের ফলে গৌরী লংকেশ বা পানেসরকে হত্যা করা হয়েছে।হাথরসে দলিত যুবতীর গণধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার রিপোর্ট সংগ্রহ করতে গিয়ে সিদ্দিক কাপ্পানকে দুবছর জেলে কাটাতে হয়েছে।বালিয়ায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের সংবাদ প্রকাশের জন্য সাংবাদিকের কাপড় খুলে নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানী হুমকি দেয় সাংবাদিকদের জেলে ঢোকানোর।সাম্প্রতিককালে এনডি টিভি যে গোদী মিডিয়ার তালিকায় নাম তোলাতে চায় নি তাকে কিভাবে ঘুরপথে আদানীদের পয়সায় কিনিয়ে নিজেদের তাবেদারি করা হয়েছে তা তো সবার অজানা নয়।ক’দিন আগে সেই চ্যানেলটির চাকরি থেকে পদত্যাগ করেছে এক তরুণ সাংবাদিক,কেননা সে মালিকের নির্দেশমত মিথ্যা খবর পরিবেশনের অংশ হতে রাজী হয় নি।কিন্তু কেন মিডিয়া ও চ্যানেলগুলো গোদী মিডিয়ার অংশ হয়ে গেল? দেশে তো অনেকগুলি চ্যানেল ও সংবাদমাধ্যম বহুবছর ধরেই রয়েছে। আসলে এত বছর ধরে কংগ্রেস তো বটেই অন্যান্য যে সব দল বা জোট ক্ষমতায় এসেছে তারা দেশের এই গণতান্ত্রিক বাতাবরণ নষ্ট করতে চায় নি।এমনকি বিজেপির নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ীর সময়ও নয়। শুধুমাত্র মিথ্যা প্রচারের ওপর নির্ভর করে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে।তার সঙ্গে রয়েছে এই ধরনের মিথ্যা প্রচার প্রতিরোধে কংগ্রেস ও বিরোধীদের ব্যর্থতা।তাই আজ মিডিয়াও অপরাধীদের ভাষা,চালচলন ও রক্তচক্ষু রপ্ত করেছে।তারা নেতাদের ভাষণ বিকৃত করা ছাড়াও অনবরত মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করছে।হোয়াটসআপ ইউনিভার্সিটির ফেক নিউজের ওপর নির্ভর করে তারা অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেও পিছপা হয় নি।সরকার এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে কি? এ প্রশ্ন সবার।তাই পবন খেরা বলেছেন ঘৃণার দোকানের গ্রাহক হতে না কংগ্রেস না ইন্ডিয়া জোট , কেউ যাবে না।সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি জোসেফ বলেছেন টিভিতে ঘৃণার প্রচার চলবে না। তিনি ৃমন্তব্য করেছিলেন এখানের বিতর্কসভায় সমান অধিকার নেই। বিরোধী বক্তাদের মাইক্রোফোনও যে মিউট করে দেওয়া হয় তা তার নজর এড়ায় নি।বিচারপতি যোশেফ সুদর্শন টিভিতে করোনা জেহাদ ও তবলিগি জামায়েত করোনা ছড়াচ্ছে বলে যে প্রচার মিডিয়া করেছিল তারও উল্লেখ করেন।কৃষক আন্দোলনের সময় কৃষকেরা গোদী মিডিয়াকে দূর করে দিয়েছিল ও নিজেরা সংবাদপত্র প্রকাশ করেছিল।কিন্তু এতদসত্ত্বেও মিডিয়া মুসলীম বিরোধী অবস্থান থেকে সরে আসে নি।এর প্রভাব যে শিশুদের ওপর পড়ছে তাতেও সবাই একমত।একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জনতাকে গুলি করে মারার আদেশ দিচ্ছেন, বলছেন “গোলি মারো শালে কো “।ভাবা যায়?মিডিয়া কবে দেশের প্রধানমন্ত্রী মোদীকে প্রশ্ন করেছে? যেখানে দেশের প্রধান বিরোধী দলের নেতা প্রায় প্রতি সপ্তাহে সাংবাদিক সম্মেলন করে সাংবাদিকদের প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দেন , একটি প্রশ্নও না এড়িয়ে গিয়ে, সেখানে দেশের প্রধানমন্ত্রী তার দশ বছর প্রধানমন্ত্রীত্বকালে একটাও সাংবাদিক সম্মেলন করার সাহস দেখাতে পারলেন না।কই তা নিয়ে গোদী মিডিয়া নিশ্চুপ কেন? যে জি-২০ সম্মেলন নিয়ে এত ঢাক পেটানো তার শেষদিনে প্রথামাফিক সাংবাদিক সম্মেলন অব্দি করা হল না।আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে অন্য একটি দেশে গিয়ে এবিষয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করতে হল।সেকারণেই আজ এই বয়কট করতে বাধ্য হল ইন্ডিয়া জোট।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *