গুজরাট থেকে মণিপুর জাতিদাঙ্গা : নায়ক একজনই

মনিরুল হক

আপনি অপেক্ষায় ছিলেন?এই কি ছিল আপনার প্রতিজ্ঞা যে অন্তত: দু’জন নারীকে নগ্ন করে হাঁটিয়ে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এ ছবি না দেখা পর্যন্ত আপনি মুখ খুলবেন না? লজ্জা, লজ্জা, লজ্জা।প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, আপনিই দেশের লজ্জা।

গুজরাট গণহত্যার সময় থেকে শুরু করে মণিপুরের এই জাতিদাঙ্গা পর্যন্ত যত অন্যায়, যত পাপকাজ তার সব পরিকল্পনাই আপনার এবং আপনার স্যাঙাৎদের মস্তিষ্কপ্রসূত। আর সে সব পরিকল্পনা রূপায়িত করছে আপনাদের হাতে থাকা রাষ্ট্রযন্ত্র। আপনারা দেশের সর্বত্র অপরাধ করে বেড়াচ্ছেন। যথেচ্ছভাবে দেশের সম্পদ লুঠ করছেন, সাধারণ মানুষের মনে ভীতি সঞ্চার করছেন, সংখ্যালঘু মুসলিম, খ্রিস্টান ও দলিতদের ইচ্ছেমতো খুন করছেন, কেউ কোনো আপত্তি বা প্রতিবাদ করলেই তাকে ধরে জেলে ভরে দিচ্ছেন, বছরের পর বছর বিনা বিচারে আটকে রাখছেন। আর গুজরাট থেকে মণিপুর সর্বত্র মহিলাদের উপর শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার, একক বা দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ, খুন, আগুনে পুড়িয়ে মারাকে জল-ভাতে পরিণত করেছেন। আপনার নেতৃত্বে সংগঠিত হওয়া গুজরাট গনহত্যার বিরুদ্ধে প্রতীক হয়ে এখনও লড়ে যাচ্ছেন বিলকিস বানো। কিন্তু দু:খের বিষয়, জম্মু, উন্নাও, হাথরাস বা মণিপুরের কন্যারা সে সুযোগ পায় নি। কাউকে সোজাসুজি খুন করা হয়েছে, কাউকে আগুনে পুড়িয়ে, কাউকে বা পিটিয়ে মারা হয়েছে। আপনার অন্যতম শাকরেদ বীরেন সিং রাষ্ট্রযন্ত্রের সাহায্যে নিয়ে আড়াই মাস ধরে মণিপুরের ভয়ঙ্কর হত্যালীলা চালিয়ে যাচ্ছেন। সামান্যতম লজ্জাবোধ থাকলে আপনি এই হত্যাকান্ড, এই ধ্বংসলীলা বন্ধ করতেন। না। আপনার বা আপনার স্যাঙাতদের কারও লজ্জাবোধের তিলমাত্রও নেই।মণিপুরের ঘটনা যে গুজরাটের সেই গনহত্যার মতোই পূর্বপরিকল্পিত তা আজ আর কারও অজানা নয়। পূর্বপরিকল্পিত না হলে তা এতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়তো না, এতো বিধ্বংসী হতে পারত না। ভেবে দেখুন, ৩ মে ইম্ফল থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে চূড়াচাঁদপুরে উপজাতি ছাত্র-যুবদের একটা শান্তিপূর্ণ মিছিলের সময় মৈতেই সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ প্ররোচনা ছড়ালো, আক্রমণ করল। আর তারপরদিনই মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সরকারের পুলিশ রাজ্যের অস্ত্রাগার, পুলিশ ট্রেনিং স্কুল ও বিভিন্ন থানার দরজা মৈতেই সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ‘মৈতেই লিপুন’ ও ‘আরামবাই তেঙ্গোল’-এর জন্য খুলে দিল। শুধু মহামান্য বীরেন সিং-এর নির্বাচনী এলাকা HEINGANG-এর থানা সহ ৭ জায়গা থেকে অস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। সন্ত্রাসবাদীরা হাসতে হাসতে হাজার হাজার ইনসাস রাইফেল, অন্যান্য আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাগুলি নিয়ে চলে গেল। কোথাও এই সন্ত্রাসবাদীদের আটকানোর কোনো চেষ্টা করা হয় নি। লুটেরাদের লক্ষ করে একটা গুলিও চলেনি; একটু ধাক্কাধাক্কি হয়েছে, এমন খবরও পাওয়া যায় নি। থানা ও অস্ত্রাগার থেকে ‘INVENTORY RECORD’ ও নিয়ে চলে গেছে সন্ত্রাসীবাবুরা। ফলে কোথায় কত অস্ত্র ছিল সে নথিও আর পাওয়া যাবে না। পুলিশ আধিকারিকদের সূত্র উল্লেখ করে সংবাদ সংস্থা পি টি আই জানিয়েছে এখনও ৩০০০ অস্ত্র এবং ৬০০০০০ গোলাগুলি সন্ত্রাসীদের কাছে রয়ে গেছে। আর এর ৫ শতাংশ আছে কুকি জঙ্গীদের হাতে, বাকি সব মৈতেই সন্ত্রাসীদের জিম্মায়। সঙ্গত কারণেই মৈতেই লিপুন-এর প্রধান প্রমোথ সিং বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং তাঁর কাছে ভগবান, তিনি তাঁকে পুজো করেন। বস্তুত: বীরেন সিং-বিজেপি- আর এস এস মিলেই গড়ে তুলেছেন মৈতেই লিপুন ও আরামবাই তেঙ্গোল- এর মতো সংগঠন।

একথা ঠিক, মণিপুরের কুকিদের মধ্যেও অনেক সন্ত্রাসী সংগঠন আছে। আগের কংগ্রেস সরকার শান্তিচুক্তির মাধ্যমে তাদের অনেকাংশেই নিরস্ত করেছিল। কিন্তু বিজেপি সেই কুকি সন্ত্রাসী সংগঠনগুলিকে পুণরায় জীবন দান করে। তাদের সাহায্যেই বিজেপি গত বিধানসভায় জয়লাভ করে। আবার মণিপুর ম্যাসাকার শুরু হওয়ার কয়েকদিন পরেই সেই সন্ত্রাসবাদী নেতাদের গুয়াহাটিতে ডেকে নিয়ে তাদের সঙ্গে মণিপুর পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন বিজেপির নতুন শর্মা হিমন্তবাবু। তাই আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না, ক্ষমতা লাভ এবং তা রক্ষার জন্য বিজেপি একদিকে কুকী সন্ত্রাসবাদীদের মদত দিচ্ছে এবং অপরদিকে মৈতেইদের মধ্যে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন গড়ে তুলেছে। অর্থাৎ সন্ত্রাসবাদীদের উপর নির্ভর করেই বেঁচে থাকতে চাইছে বিজেপি। মণিপুরের সাধারণ মানুষের কি হল বা কি হবে তা নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। বীরেন সিং-এর পক্ষে দাঁড়িয়ে আগুন লাগানো, খুন করা, চরম নৃশংসতার পরিচয় দেওয়া মৈতেই সম্প্রদায়ের একাংশও আজ বুঝতে পারছেন বড্ড ভুল হয়ে গেছে!মণিপুরের বহুআলোচিত ভিডিওটি প্রকাশ্যে আসার পর সারা দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। জনজাতি মানুষদের উপর হামলা অত্যাচারের বিরুদ্ধে ঝাড়খন্ড ও গুজরাটে বিক্ষোভ সংগঠিত হয়েছে। ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে ও প্রতিকার চেয়ে রাষ্ট্পতি দ্রৌপদী মুর্মুকে চিঠি লিখেছেন। মিজোরামে বিশাল মিছিল ও সমাবেশ সংগঠিত হয়েছে। এতোদিন চুপ করে থাকা নাগা সংস্থাগুলিও প্রতিবাদে মুখর হয়েছে। ভিডিওটি প্রকাশ্যে আসার পর তার সত্য-মিথ্যা নিয়ে নানা মহল থেকে নানা কথা উঠছিল। সেজন্য কুকি সংগঠন থেকে মোট ১৩ টি নৃশংস ঘটনার বিশদ বিবরণ প্রকাশ্যে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। মিজোরাম প্রদেশ বিজেপির সহ-সভাপতি নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহকে দোষী সাব্যাস্ত করে ক’দিন আগেই পদত্যাগ করেছেন। বিজেপি ছাড়া বাকি সব দল মণিপুরের ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন এবং অপদার্থ, পক্ষপাতদুষ্ট বীরেন সিং-কে বরখাস্তের দাবি করেছেন। নাম-কে-ওয়াস্তে ঘটনার নিন্দা করলেও মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং কে সরিয়ে দেওয়ার দাবিতে বিজেপি কর্ণপাত করছে না।

আমাদের সংসদীয় রীতি অনুযায়ী, অধিবেশন চলা কালীন সময়ে বিশেষ কোন বিবৃতি বা ঘোষণার জন্য সরকার পক্ষ সংসদেই বেছে নেন। কিন্তু সারা দেশের মানুষ অবাক দেখলেন সংসদকে অবজ্ঞা করে প্রধান মন্ত্রী সংসদ কক্ষের বাইরে মণিপুরের ধর্ষণ কান্ডের সামান্য উল্লেখ করেই কংগ্রেস শাষিত রাজ্যগুলিকে জুড়ে নিয়ে নারী নিগ্রহের বিষয়গুলি শক্তহাতে মোকাবিলা করার জন্য সংশ্লিষ্ট মুখ্যমন্ত্রীদের নির্দেশ দিলেন। সঙ্গত কারণেই বিরোধী সাংসদরা দাবি করেছেন, প্রধানমন্ত্রীকে সংসদ কক্ষের মধ্যে সাংসদদের সামনে মণিপুর নিয়ে কথা বলতে হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দল তা করতে রাজী নয়। উল্টে লোকসভা ও রাজ্যসভার অধ্যক্ষ মণিপুরের ঘটনার বিস্তারিত আলোচনা চাওয়ার জন্য সাংসদদের প্রতি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন। বাধ্য হয়ে বিরোধী INDIA জোট সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। তারা চাইছে মণিপুর নিয়ে আলোচনা হোক, প্রধানমন্ত্রী মুখ খুলতে বাধ্য হোক।

অনেকে বলছেন প্রধানমন্ত্রী ভয় পেয়েছেন। তা হয়ত নয়। তিনি এবং তার দল তো অনেক দিন ধরেই ছোট-বড় নানা অপকর্ম করে আসছেন। তার মধ্যে বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনাটা অন্তত: সবার মনে আছে। মসজিদ ভাঙার ঘটনা তখন বীরদর্পে স্বীকার করলেও পরবর্তী সময়ে আদবানী সহ সকলে শাস্তির ভয়ে তা অস্বীকার করেন। সেই একই ধারা মেনে গুজরাট গণহত্যা বা মণিপুর গণহত্যা নিয়ে আগ বাড়িয়ে আর দায়িত্ব স্বীকার করছেন না। তাই বলে আমাদের দায়িত্ব কিন্তু শেষ হচ্ছে না।মানুষের অসাবধানে রাতের অন্ধকারে হানা দিয়ে ধূর্ত শেয়াল ভোরবেলায় গর্তে ঢুকে যাচ্ছে। মানুষকে সাবধানে থাকতে হবে। ঘাপটি মেরে থাকা ধূর্ত শেয়ালকে গর্ত থেকে টেনে বার করে দিনের আলোয় দাঁড় করাতে হবে। এ দায়িত্ব আমার আপনার সবার।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *