চন্দন পাল
সর্ব সেবা সংঘ (সর্বভারতীয় সর্বোদয় মণ্ডল) হল গান্ধীবাদী চিন্তাধারার জাতীয় শীর্ষ সংগঠন। এটি ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেবাগ্রাম সম্মেলনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আচার্য কৃপালনি, আচার্য বিনোবা ভাবে, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, ডক্টর জাকির হুসেন, লোকনায়ক জয়প্রকাশ নারায়ণ, জে সি কুমারাপ্পা এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু সহ অন্যান্য শীর্ষ জাতীয় নেতারা এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য যে আচার্য বিনোবা ভাবের উদ্যোগে এবং লালবাহাদুর শাস্ত্রী, জগজীবন রাম, রাধাকৃষ্ণ বাজাজ এর সহযোগিতায় সর্ব সেবা সংঘ ১৯৬০ , ১৯৬১ এবং ১৯৭o সালে রেলওয়ে থেকে রাজঘাট, বারানসী, উত্তরপ্রদেশে মোট ১২’ ৮৯ একর জমি ক্রয় করে। কেনা তিনটি স্থানের জমির নিবন্ধিত বিক্রয় দলিল রয়েছে যাতে স্বাক্ষর করেছেন ডিভিসনাল ইঞ্জিনিয়ার, নর্দান রেলওয়ে, লখনউ। ১৯৬০ সালে কেনা জমির অর্থমূল্য ছিল ২৬৭৩০ টাকা, ১৯৬১ সালে কেনা জমির অর্থমূল্য ছিল ৩২৪০ টাকা এবং ১৯৭০ সালে কেনা স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, বারাণসী ট্রেজারি চালান নং ১৭১ ঘ ৫ মে ১৯৫৯, ট্রেজারি চানাল নং ৩১. ২৭.০৪.১৯৬১ এবং ট্রেজারি চালান নং ৩ দিন ১৮’ ০১’ ১৯৬৮ এর মাধ্যমে অর্থ প্রদান করা হয়েছে এবং সরকারের কোষাগারে সম্পূর্ণ অর্থ জমা হয়েছে।
১৯৫৬ সাল থেকে বারাণসীতে সর্ব সেবা সংঘের কাজ চলছে। ১৯৬০ সালে, যখন সর্ব সেবা সংঘ রেলওয়ের কাছ থেকে জমি কিনেছিল, তখন এখানে সাধনা কেন্দ্র পরিসর তৈরি করা হয়েছিল এবং ১৯৬৪ সালে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী এই সাধনা কেন্দ্রের উদ্বোধন করেছিলেন। তারপর এখানে সর্ব সেবা সংঘের কাজ শুরু হয়। সর্বোদয়ী ও প্রবীণ গান্ধীবাদী আচার্য বিনোবা ভাবে, লোকনায়ক জয়প্রকাশ নারায়ণ ও তাঁর স্ত্রী প্রভাবতী দেবী, অচ্যুত পটবর্ধন, ধীরেন্দ্র মজুমদার, বালকোভা ভাবে, দাদা ধর্মাধিকারী, মনমোহন চৌধুরী, নারায়ণ দেশাই, বিমলা ঠাক্কর, সিদ্ধিরাজ ঢাড্ডা , কৃষ্ণরাজ মেহেতা, শংকর রাও দেব, আচার্য রামমূর্তি, কে. এস. রাধাকৃষ্ণ, অমরনাথ ভাই, রামচন্দ্র রাহি প্রমুখের কর্মস্থল হয়েছে। এ সাধনা কেন্দ্র প্রাঙ্গনে অবস্থানকালে বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ ‘Small is Beautiful’ রচনা করেন বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. ই.এফ. শুমাখার।
এটি উল্লেখযোগ্য যে ১৯৬০ সালে লোকনায়ক জয়প্রকাশ নারায়ণ সর্ব সেবা সংঘকে গান্ধীবাদী চিন্তাধারার উচ্চতর অধ্যয়ন এবং গবেষণার জন্য একটি জাতীয় ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করার পরামর্শ দেন। তদনুসারে সর্ব সেবা সংঘ তার নিজস্ব জমিতে বারাণসীর রাজঘাটে The Gandhian Institute of Studies (গান্ধী বিদ্যা সংস্থান) প্রতিষ্ঠা করে। সর্ব সেবা সংঘ এই ইনস্টিটিউটের জন্য তার ক্রয়কৃত জমি ব্যবহার করেছে এবং ইউ পি গান্ধী স্মারক নিধি এই জমিতে ভবন নির্মাণ করেছে। এভাবে গত ৬ দশক ধরে জাতি ও সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে সাধনা কেন্দ্র পরিসরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও অবদান রয়েছে। এই প্রাঙ্গণেই রয়েছে সর্ব সেবা সংঘের প্রকাশন বিভাগ, যেখান থেকে সারা দেশের ৭০টি রেলস্টেশনে পরিচালিত ‘সর্বোদয়’ বইয়ের স্টলের মাধ্যমে ‘গান্ধী-বিনোবা জেপি’ সহ দেশের মনীষীদের সাহিত্য পৌঁছে দেওয়া হয়। ১১ এপ্রিল, ২০২৩ -এ উত্তর রেলওয়ে, লখনউ এর পক্ষ থেকে বারাণসীর ডেপুটি কালেক্টর, সদর সর্ব সেবা সংঘের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে। এই মামলায় বলা হয়েছে, ১৯৬০, ১৯৬১ এবং ১৯৭০ সালে রেলওয়ে থেকে সর্ব সেবা সংঘ কর্তৃক ক্রয়কৃত সমস্ত জমির নথি জালিয়াতি (কুটরচিত) করে প্রস্তুত করা হয়েছে এবং এটি অপরাধমূলক কাজ।
এর অর্থ দাঁড়ায় আচার্য বিনোবা ভাবে, লোকনায়ক জয়প্রকাশ নারায়ণ, লালবাহাদুর শাস্ত্রী, জগজীবন রাম, রাধাকৃষ্ণ বাজাজ এবং ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের মতো ব্যক্তিরা হলেন প্রতারক বা জালিয়াত। দেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী, দেশহিতৈষী এই মনিষীদের প্রতি এই লাঞ্ছনা অত্যন্ত লজ্জাজনক ও নিন্দনীয়।
হঠাৎ ১৫ মে ২০২৩-এ, বারানসী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল সেন্টার ফর আর্টসের কর্মকর্তারা ভারী পুলিশ বাহিনী নিয়ে ক্যাম্পাসে আসেন। এ বিষয়ে কমিশনার সর্ব সেবা সংঘকে কোনো অগ্রিম সূচনা দেননি। ক্যাম্পাসে আসা ভারী পুলিশ বাহিনী দেখে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, আপনি হঠাৎ এখানে কেন এলেন? তারপর জানা গেল, বিভাগীয় কমিশনারের নির্দেশ অনুযায়ী, গান্ধী বিদ্যা সংস্থানের গ্রন্থাগার, প্রশাসনিক ভবন ও প্রাঙ্গণ ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল সেন্টার ফর দ্য আর্টসকে দেওয়া হয়েছে। বিভাগীয় কমিশনারের এই নির্দেশের কোন কপি সর্ব সেবা সংঘকে দেওয়া হয়নি।
ইতিমধ্যে রেজিস্টার্ড লীজ ভীড অনুসারে গান্ধী বিদ্যা সংস্থানের জন্য উপলব্ধ জমির ক্ষেত্রে, মাননীয় হাইকোর্ট, এলাহাবাদ (মামলা নং ২৯৯৭৫/২০০৭) তারিখ ১৬.০৫.২০২৩ তারিখের আদেশে বারাণসী জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছে যে দু মাসের মধ্যে জমি সংক্রান্ত নথিগুলি যাচাই করে সর্ব সেবা সংঘের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। মাননীয় আদালতের নির্দেশ অনুসারে, গান্ধী বিদ্যা সংস্থানের জন্য ইজারা দেওয়া জমির বিষয়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বারাণসীকে সিদ্ধান্ত জানানোর কথা ছিল, কিন্তু মাননীয় আদালতের আদেশের অবমাননা করে তিনি এই সম্পর্কিত তথ্য প্রমাণ চেয়েছিলেন। এতদসত্বেও সর্ব সেবা সংঘের জমি সংক্রান্ত কাগজপত্র উপস্থাপন করা হয়েছিল। সেই প্রমাণগুলি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, তিনি তাঁর আদেশে বলেছেন যে ১৯৬০, ১৯৬১ এবং ১৯৭০ সালে সর্ব সেবা সংঘ কর্তৃক ক্রয়কৃত জমি রেলওয়ের অন্তর্গত যদিও জমি সংক্রান্ত সমস্ত নিবন্ধিত নথি সর্ব সেবা সংঘের কাছে জমা আছে।
উত্তরপ্রদেশ সরকার ও প্রশাসনের এই ধরনের অনৈতিক ও বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে দেশব্যপী গান্ধীবাদীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। ১৫ মে, ২০২৩ থেকে গান্ধীজন ও গান্ধী জেপি বিরাসত বাঁচাও সংঘর্ষ সমিতির ডাকে সত্যাগ্রহ চলতে থাকে। এই সত্যাগ্রহে সারাদেশ থেকে গান্ধী, বিনোবা, জেপি অনুরাগীসহ সহযোগি সংগঠনগুলির সদস্যরা অংশ নেন। একই সময়ে, সর্ব সেবা সংঘের সভাপতি শ্রী চন্দন পালের আবেদনে সাড়া দিয়ে উত্তরপ্রদেশ সরকারের এই আচরণের বিরুদ্ধে সারা দেশের অনেক রাজ্যে ধর্না, সত্যাগ্রহ, পদযাত্রা, অনশন, স্মারকলিপি প্রদান ইত্যাদি কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হতে থাকে। এই সত্যাগ্রহ আন্দোলন ধীরে ধীরে তীব্রতর রূপ ধারণ করে।
সত্যাগ্রহের ৬৩ তম দিনে অর্থাৎ ২২শে জুলাই, ২০২৩-এ হঠাৎ করেই সকাল ৬.৩০ টার দিকে, বিপুল সংখ্যক উত্তরপ্রদেশ পুলিশ / রেলওয়ে পুলিশ (প্রায় ১০০০), কোনো তথ্য ছাড়াই আশ্রম প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে এবং অবিলম্বে প্রাঙ্গণ খালি করার হুমকি দেয়।
যখন পুলিশ কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে আপনাদের কাছে কি প্রাঙ্গণ খালি করার কোন লিখিত নির্দেশ আছে ? প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পুলিশ দল সর্ব সেবা সংঘের সত্যাগ্রহ মঞ্চকে সরিয়ে দিতে শুরু করেন। এর প্রতিবাদে সভাপতি চন্দন পাল ও রাম ধীরাজের নেতৃত্বে কয়েকজন সাথী পুলিশ বাহিনীর সামনে বসে শান্তিপূর্ণভাবে এই অন্যায় ও অত্যাচারের প্রতিবাদ করেন। খবর আসে যে ক্যাম্পাসের ভিতরে বসবাসকারী সকল কর্মীদের বাড়ি খালি করার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে, সর্ব সেবা সংঘ প্রকাশন সমিতির কার্যালয় থেকে সব সরঞ্জাম, লাইব্রেরীর বহু মূল্যবান বই ফেলে দেওয়া হচ্ছে। সর্বোদয় প্রকাশন বিভাগের কোটি কোটি টাকার অসংখ্য নতুন-পুরনো বইও ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এই সমস্ত খবর পৌঁছানোর সাথে সাথে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আরও জোরালো হতে থাকে। পুলিশ পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে সভাপতি চন্দন পাল, রাম ধিরাজ, নন্দলাল মাস্টার, ঈশ্বরচাদ সহ ছয়জনকে একটি পুলিশ ভ্যানে করে বারানসী পুলিশ কমিশনের কার্যালয়ে নিয়ে যায়, এবং পরে সর্বোদয় প্রকাশন সমিতির সংযোজক অরবিন্দ অঙ্কুম সহ দুজনকে তুলে নেওয়া হয়। কয়েকঘন্টা বসে থাকার পর এই আটজনকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া হয়।সর্ব সেবা সংঘের বারাণসী ক্যাম্পাস, যা প্রায় ১৩ একর জমির উপর অবস্থিত, পুরো ক্যাম্পাসটি সেই পুলিশ বা রেলওয়ে দ্বারা তালাবদ্ধ করা হয়েছে। গত ৬৩ বছর ধরে, এই ঐতিহ্যবাহী আশ্রম পরিসরটি যা গান্ধী চিন্তাকে সারা দেশে বিদেশে ছড়িয়ে দিয়েছে, যে জায়গাটি গান্ধীজীর বিভিন্ন গঠনমূলক কর্মকেন্দ্র হিসেবে সুপরিচিত, শান্তি আন্দোলনের পটভূমি, অনুপ্রেরণার জায়গা তা আজ সবরমতী আশ্রমের মতো এই জায়গাটিও দেশের তথাকথিত উন্নয়নের নামে কর্পোরেটদের পুঁজি বাড়াতে বিলাসবহুল হোটেল, মল ইত্যাদির জন্য ব্যবহারের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে এবং সেই উদ্দেশ্যে তালাবন্দি করা হয়েছে।
বর্তমান দেশের সার্বিক পরিস্থিতির দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট যে, দেশের সরকার সব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ভেঙে দিয়ে ভয়ের পরিবেশ তৈরী করে এক স্বৈরাচারী শাসন কায়েম করতে চায়। মূদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, নারীর মর্যাদা হরণ, কৃষকদের সমস্যা ইত্যাদি বিষয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই। সাধারণ জনগণের টাকা দিয়ে কর্পোরেট ও পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করাই এই সরকারের অন্যতম কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমরা মনে করি, এটা শুধু সরকার কর্তৃক সর্ব সেবা সংঘের কেনা জমি দখলের পরিকল্পনা নয়, যেভাবে ষড়যন্ত্র করে বাপুকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে, একইভাবে গান্ধীর চিন্তাভাবনা আদর্শকে সম্পূর্ণভাবে জনগণের মন থেকে মুছে ফেলার জন্য এটি একটি সুচিন্তিত ষড়যন্ত্র। আমাদের বিশ্বাস ও আস্থা দেশের সংবিধানে বিশ্বাসী আপামর প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, বহুত্ববাদী, সংস্কৃতি-সমৃদ্ধ সংবেদনশীল জনগণ এই জঘন্য ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবেন এবং এ ধরনের অন্যায় কাজ করার সাহস যারা দেখিয়েছে, ক্ষমতা থেকে তাদের অপসারণের পথ দেখাবেন।
————————————————————
লেখক সর্ব সেবা সঙ্ঘের সর্ব ভারতীয় সভাপতি।